যা কখনো হয়নি তাই হলো মসজিদে হারাম ও নববীতে। করোনার কারণে সেখানে জুমার নামাজ বন্ধ রয়েছে। মানুষের জীবনের কথা ভেবে সৌদির এই দুই মসজিদে নামাজ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির সরকার। আমরা কেন পারছি না? এমনকি নির্বাচনের মতো আয়োজন বন্ধেও আমাদের কেন এত কাপণ্যতা? আমরা কেন সতর্ক হচ্ছি না। বিশ্বের ১৮৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩২ জন এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ১১ হাজার ৩৯৮ জন। তবে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৯১ হাজার ৯১২ জন। আতঙ্কিত না হয়ে কি পারা যায়? গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। এরপর থেকেই চীনের বিভিন্ন প্রান্তে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। বাংলাদেশেও করোনায় ২ জন মারা গেছেন। আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ জন। আমাদেও দেশেও মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নিয়েছে করোনাভাইরাস। বিশ্বব্যাপী মহারারি আকার ধারণ করা প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে দরিদ্র দেশগুলোর কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস। যখন এ লেখাটি লিখছি এর দু’দিন আগে এমন শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বিশ^ জুড়ে সবখানে সতর্কতা। আতংক। আমাদের দেশে বেশ আতঙ্ক আছে; সতর্কতা কম। মানুষ বাজারে যাচ্ছে, রাস্তায় গাড়ি চলছে, ভোটও হচ্ছে। সারা দেশ যখন আতংকিত। সারা বিশে^ যেখানে থমকে গেছে; অনেক দেশেই অনেক কর্যক্রমই বন্ধ রয়েছে। আমাদের দেশেও স্কুল, কলেজসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ইসলামী সভাসমাবেশসহ সরকারের পক্ষ থেকে সকল সমাগম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে ভোট গ্রহণ কি না করলেই হতো না? নিশ্চয় ইসি সংবিধানের কথা বলবেন। সংবিধানের বিরোধীতা করার সুযোগও নাই, তবে জীবনের চেয়ে ইসির কাছে কি সংবিধান বড় হয়ে গেলো? আজ ২১ মার্চ দেখলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে এসেছেন। যিনি দেশকে উন্নয়নের উচ্চ শিখরে নিতে রাত দিন কাজ করছেন। এদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর কথাও কি একবারের জন্যও ভাবলেন না ইসি। মাননীয় ইসি বিষয়টি বোধ করি হেয়ালীভাবেই নিয়েছেন। যা মোটেও সমোচিন হয়নি। মানুষ কিন্তু কষ্টের কথা আমাদের কাছে বলছেন। দেশের এমন অবস্থায় ভোট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সাধারন মানুষ ভালো দৃষ্টিতে নেয়নি। অনেকেতো বলেছেন, আমাদেও জীবনের কি কোনই মূল্য নেই। ঝুঁকি নিয়ে কেন ভোট দিতে যাব? কথাতো মন্ধ বলছে না জনগন। যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে সভা সমাবেশ বন্ধ করা হয়েছে, সেখানে ভোটের মতো একটি আয়োজন এ রাষ্ট্রেই কি চলতে পারে? জনগনকে সভা সমাবেশ করতে নিষেধ করবেন, আবার নির্বাচন চালিয়ে যাবেন বিষয়টি সাংঘর্ষিকতো বটে! বঙ্গবন্ধুর শতবার্ষিকি বলে কথা। এই দিনটি জাতীর জন্য বারবার ফিরে আসবে না। এমন দিনে (১৭ মার্চ) জনস্বার্থে মূল আনুষ্ঠান যেখানে বন্ধ করা হলো। মুজিবশতবর্ষ পালনে সারাদেশেই ব্যাপক প্রস্তুতি ছিলো। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তা সীমিত করা হয়েছে। সেখানে ভোটতো মাননীয় ইসি পরেও করা যেতো। আপনি ভোট বন্ধ না করে জনগনকে আরও আতংকগ্রস্ত করেছেন বৈকি। আপনিও দেশ জুড়ে হয়েছেন বিতর্কিত। মাননীয় ইসি, আপনাকে একা দুষে লাভ কি? অমরা জনগনও কিন্তু কম নাই। অসভ্যতারতো একটা সীমা থাকা চাই। দেরিতে হলেও করোনা ভাইরাসের নিরাপত্তার কথা ভেবে স্কুল কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলো সরকার; তাতে ফায়দা কি হলো? ছুটি পেয়েই দে.. ছুট। অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে কক্সবাজার আর পর্যটন ষ্পট গুলোতে পাড়ি জমালো। এমন অবস্থায় সরকার কক্্রবাজারসহ পর্যটন ষ্পট গুলো বন্ধ করতে বাধ্য হলো। কতটা অসভ্য আমরা। অসচেতন আর কাকে বলে? এমনিতেইতো ভাবনার শেষ নাই। বিদেশ থেকে দেশে ঢুকেছে প্রায় ৬ লাখ দেশী এবং ভীনদেশী। হাস্যকর হোম কোয়ান্টাইনের কথা শুনছি এখন। সেটা কি তাই তো বুঝি না। যেখানে জেল জরিমানা দিয়ে মানুষ বশ করা যায়না সেখানে সেচ্ছায় বাসগৃহের কোয়ারেন্টাই। বাহ্। ভালইতো। আমারা সতর্ক নই বললেই চলে। জনসমাগম সবখানেই হচ্ছে। হাটবাজার পুরদমে জমছে। ইসলামীক সমাগমও বন্ধ নেই। আগের চেয়ে বাজারে এখন বেশি মানুষ। মানুষের হুশ নেই। আগাম পণ্য কিনতে বাজারে ছুটছেতো ছুটছেই। এই সুযোগে চাল, ডাল, তেল, ঝাল, মরিচের দাম বেড়েই চলেছে। ক’দিন পরে নাকি বাজার থেকে খাদ্য পণ্য উধাও হয়ে যাবে। হুজুগে বাঙ্গালতো বলছে; নাকি দু:ভিক্ষ লেগে যাবে দেশে। পঙ্গপালের কথাও কেউ কেউ বলছেন। আমি তো ভাবছি মুনুষ মরার কথা। আল্লাহ মাফ করুক আমাদের। মানুষ মরলে কারা কিনবে এসব পণ? কারাইবা খাবেন মজুত করা খাবার। শোকাহত মানুষের খাদ্য খাবারের প্রতি মন এনিতেই কমে যাবে। তাছাড়া শহরে মানুষ কিন্তু কিছুটা সচেতন। ঢাকা শহরেতো এখন যানজট নেই বললেই চলে। ঢাকা এখন ফাঁকা হচ্ছে। হোটেল রেস্তোরায় মানুষ কম যাচ্ছে? মানুষ বাহিরের খাবার খাচ্ছে কম। ঢাকাসহ অপরাপর শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে মানুষ। পণ্যের চাহিদাতো উল্টো কমবে। চাহিদা কমলে পণ্যমূল্য না কমে বাড়বে কি করে? হুজুগ, হুগুগ আর হুজুগে বাঙ্গাল। চিলে কান নিয়েছেতো চিলের পেছনেই ছুটছে মানুষ। টাকা পাতা (থানকুনি পাতা) খেলে করোনা ধারে কাছে নাকি আসে না; এ কথা ফেসবুকে দেয়ার পর ১০ টাকার পাতা এখন নাকি ২’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতে এমন প্রচার গোমূত্র নিয়েও। একারনে ভারতে গোমূত্রের দাম নাকি এখন বেশ চড়া। বাংলাদেশেও যদি কেউ বলে ফেলেন গোমূত্র পান করলে করোনা উধাও হবে। আর তা যদি ফেসবুকে কেউ ভাইরাল করতে পারে তাহলে মুসলমানও হয়তো গোমূত্র পান শুরু করবে। এদেশেও বোধ করি গোমূত্রের টান পড়ে যাবে। তখন গরুর পেছেনে হা করে লাইনে থাকবে হয়তো হুজুগে মানুষ। ক্ষেত্র বিশেষ কিউ কেউ মহা সংকটের গোমূত্র পেতে গরু কেটে কিডনি থেকে গোমূত্র চিপে বের করতে চাইবেন। হুজুগে বাঙ্গাল বলে কথা। সারা বিশ্ব যেখানে সতর্ক সেখানে আমাদের দেশে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক। পরে হয়তো বুঝতে পারব কতটা ক্ষতি হলো আমাদের। আল্লাহ মাফ করুক। একটা কথা মনে রাখতে হবে সার্স, ডেঙ্গু বা ইবোলার মতো নানা ধরণের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এমন মহাবিপদ থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধারও করেন। ইসলাম ধর্মে এসব রোগ-বালাইয়ের ব্যাপারে আমাদেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আল-কোরআনে মহামারী হলে যেযার স্থানে থাকার কথা বলা আছে। অন্য ধর্মেও রোগের ক্ষেত্রে সতর্ক করা আছে। প্রয়োজন না হলে ক’দিন নিজের জন্য; পরিবারের জন্য; অন্যের জন্য ঘর থেকে বাহিরে না যাওয়াই ভালো। প্রয়োজন থাকলে কি আর করা। আল্লাহ ভরসা। মনে রাখবেন এ সমস্যা কিন্তু অনেক দিন ধরেই থাকবে না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেনই। কিছুদিন যারা সতর্ক থাকতে পারবেন, সবকিছু ঠিকঠাক মেনে চলবেন তারা হয়তো এ বিপদ থেকে অনেকটা মুক্ত থাকতে পারবেন। তবে আমারা বেশিই অসাবধান মনে হয়। কোন কিছুকেই গুরুত্ব দিতে চাইনা কখনো। কোন কিছু মানতে চাইনা। আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন। করোনা ভাইরাস আতঙ্কে ভোগ্য পণ্য ক্রয়ের হিড়িকের কথা বলছিলাম। মানুষ বাজাওে গিয়ে লাইন ধরে পণ্য কিনছেন। গিন্ন ফরমাইশী নিত্য বাজার করতে বাসার পাশের পাইকারী দোকানে ভিড় দেখে ভয়েই সেখানে ঢুকিনি সেদিন। প্রয়োজনীয় বাজার না আনায় রাতে বেশ বকুনী জুটেছে কপালে। পরদিন বাসার কাজের জন্য প্লাইবোর্ড কিনতে রাজধানীর গুলশান বাড্ডা এলাকার এক কাঠের দোকানে ঢুকলাম। ঢুকতেই দেখি কয়েক বস্তা করে ডাল, চাল আর চিনি সাজানো। কাঠ আর কি কিনব, গিন্নির চাহিদার জিনিসতো কাঠের দোকানেই পেলাম। বেশ খুশী হলাম। কাঠের কথা না বলে (রহস্য করে) ডাল, চাল, চিনির দাম জিঙ্গাস করতেই ঐ দোকানের জনৈক কর্মচারি বললেন ‘স্যার এটা বসের বাসার জন্য কে না, বিক্রির জন্য নয়’। আসলে সব বসেরই এখন এক রূপ। পণ্য কিনে সারাবর করছে বাজার। দিন আনা দিন খাওয়া লোকদের কি হবে ভাবনায় নেই কারো। একসাথে সবাই বেশি বেশি পণ্য কেনায় বাজাওে সংকট তৈরি হয়েছে। পণ্য মূল্যের দাম রাতারাতি বাড়ছে। এমনিতেইতো এদেশের ব্যবসায়ীদের স্বভাব বেশ ভালো! তার উপর এমন অজুহাত পেলে কি আর রক্ষা আছে? যা হবার তাই হচ্ছে। বাজারে রীতিমতো আগুন লেগেছে। তবুও হুজুগে মানুষের
কেনাকাটা বন্ধ নেই। বোধ করি কেউ কেউ বউয়ের গয়নাগাটি বিক্রি করেও পণ্য মজুতে নেমেছেন হয়তো। প্লিজ দোহাই আপনাদের এভাবে পণ্য কিনে বাজারে সংকট তৈরি করবেন না। আপনাদের কারণে দিনএনে দিনখাওয়া মানুষগুলো কষ্টে পড়বে। আপনি হয়তো এক টাকার জিনি দু’টাকায় কিনতে পারবেন। তাঁদের কি হবে? করোনা আতংকে এমনিতেই অনেকে বেকার। আয়রোজগার কমেছে। তার উপর পণ্যমূল্যের চাপ তারা কি করে সামাল দিবে বলুন? করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। ঘুরতে না যাওয়ার, বেশি মানুষ এক জায়গায় না হওয়ার, আড্ডাবাজি বন্ধ করতে হবে। করোনা নামক শত্রু এদেশে ঢুকে পরেছে। সবাই সতর্কতার যুদ্ধে ঝাপিয়ে না পরলে আমরা হয়তো এ যুদ্ধে হেরে যাব।আসুন সবাই সতর্কতার যুদ্ধে নামি। যেহেতু করোনার ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি সেজন্য সতর্কতার যুদ্ধের বিকল্প নাই। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। যুদ্ধ জয়ের জন্য আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হলে চলবে না। দিশেহারা হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিকভাবে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখতে হবে। নিজে সতর্ক থাকতে হবে অপরকে সতর্ক করতে হবে। ভাইরাস থেকে রক্ষার একটাই পথ সতর্কতা। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাড করোনাভাইরাস এর কারণে বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এটা ভাববারই বিষয়। তবুও আমরা ভয় পাই না। সাহস নিয়ে এগিয়ে যাই। আমরা যোদ্ধার দেশ। আমরা যোদ্ধা। আল্লাহ আমাদের সহায় হবেনই। এটা আমাদেও বিশ^াস। আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করে দেশ পেয়েছি। ডেঙ্গু, কলেরা-ডায়েরীয়ামহামারী সামনে ফেলে সফল হয়েছি। করোনা ভাইরাস মোকাবেলা কওে আমদের এ পরিস্থিতিও জয় করতেই হবে। সব ভয়কেই দুরে সরিয়ে নির্ভয়ের, নিরাপদের বাংলাদেশ গড়তেই হবে আমাদের।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক