করোনার প্রভাবে মার্চ থেকে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব রুট। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে টিকিট বিক্রি, কার্গো পরিবহন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং থেকে আসা রাজস্ব আয়। গত ৩ মাসে বিমান অন্তত ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। কিন্তু সংস্থাটির নিয়মিত ব্যয় চলছেই। এমন পরিস্থিতিতে ব্যয় সংকোচনে লিজে আনা ইঞ্জিন ও যন্ত্রাঙশ ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সাথে বিমান কর্মীদের ওভারটাইম ভাতা বাতিল করার পাশাপাশি ষষ্ঠ থেকে এর ওপরের গ্রেডের কর্মকর্তা এবং ককপিট ও কেবিন ক্রুদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ হারে কাটারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রাজস্ব আয় না থাকলেও সংস্থাটির বহরে থাকা ১৮টি উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণেই প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে ২৬৬ কোটি টাকা। তাছাড়া লিজে আনা ৬টি উড়োজাহাজের জন্য প্রতি মাসে ৯৮ কোটি টাকা, বোয়িং থেকে কেনা উড়োজাহাজের কিস্তি ৭০ কোটি টাকা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ও দেশে-বিদেশে অফিস রক্ষণাবেক্ষণে ২০৩ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। তাছাড়া কভিড-১৯-এ সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় আগেই বিক্রি করা টিকিটের টাকা যাত্রীদের নগদ অর্থে পরিশোধ করা হচ্ছে। বর্তমানে বিমানের টিকিট বিক্রি, কার্গো পরিবহন ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বাবদ কোনো আয় নেই। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই ব্যয় সংকোচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, বড় দূরত্বের রুট না থাকায় স্বাভাবিক সময়েই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বহরের উড়োজাহাজগুলোর পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছিল না। ফলে সংস্থাটি লোকসানে চলছিল। আর করোনার প্রভাবে গত মার্চ থেকে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব রুটের ফ্লাইট। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে বহরে যুক্ত করা উড়োজাহাজগুলোকে বিমানবন্দরে বেকার বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। ফ্লাইট চলুক আর না চলুক, উড়োজাহাজগুলো রক্ষণাবেক্ষণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে প্রতি মাসে ঠিকই ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। বর্তমানে সংস্থার বহরে উড়োজাহাজ রয়েছে মোট ১৮টি। তার মধ্যে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং থেকে সরাসরি কেনা হয়েছে ১২টি। তার মধ্যে ৪১৯ আসনের লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ রয়েছে ৪টি। ২০১১-১৪ তিন বছরের মধ্যে উড়োজাহাজগুলো বিমানবহরে যুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে যুক্ত হয় ১৬২ আসনের দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও ২৭১ আসনের ছয়টি বোয়িং ৭৮৭ ‘ড্রিমলাইনার’ উড়োজাহাজ। বাকি ৬টি উড়োজাহাজের মধ্যে ৪টি ৭৩৭-৮০০ ও ৭৪ আসনের দুটি ড্যাশ-৮ লিজে আনা হয়েছে। লিজে আনা ৬টি উড়োজাহাজের জন্য প্রতি মাসে ৯৮ কোটি টাকা, বোয়িং থেকে কেনা উড়োজাহাজের কিস্তি বাবদ ৭০ কোটি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও দেশ-বিদেশের অফিস রক্ষণাবেক্ষণে সংস্থাটিকে আরো ২০৩ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। যদিও বিমানের টিকিট বিক্রি, কার্গো পরিবহন ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বাবদ আয় এখন একেবারেই শূন্য। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইনসটি মারাত্মক আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, বিমানের লোকসান কমাতে ব্যয় সংকোচনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাড়ায় আনা ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ যেখান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে সেখানে ফেরত পাঠানো হবে। পাশাপাশি উড়োজাহাজ, প্রকৌশল সরঞ্জাম ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সরঞ্জামের ন্যূনতম ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। তাছাড়া চাহিদা ও লোড অনুযায়ী উড়োজাহাজ স্কেলড ডাউন করা, প্রযোজ্য ন্যূনতম চার্জের মধ্যে পিবিএইচ চুক্তি, সিএসপি প্রোগ্রাম লিজ চুক্তি-মেইনটেন্যান্স রিজার্ভস প্রত্যাহার করা, বিমানের উড়োজাহাজগুলো আবশ্যিকভাবে প্রকৌশল ও ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট অধিদপ্তরের ম্যানুয়াল অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সাথে প্রকৌশল ও ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উড়োজাহাজ সংরক্ষণে পুশব্যাকের বিষয়টি নিশ্চিত করা, উড়োজাহাজের সুরক্ষার জন্য ছোট যন্ত্রাংশ সুরক্ষিত স্থানে সংরক্ষণ করা ও সর্বোপরি প্রকৌশল শাখার সব অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বৈশ্বিক ভ্রমণবিষয়ক বিশেষজ্ঞ গ্রুপ এটমোস্ফিয়ার রিসার্চ গ্রুপের তথ্য মতে, করোনা ভাইরাসের কারণে বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে আরো টানা দুই বছর সময় লাগতে পারে। অর্থাৎ ২০২৩ সাল নাগাদ বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে। তাদের মতে, যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত ফিরে আসার পরিবর্তে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে। আর সবার আগে আভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যবস্থা চালু হবে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করার পর প্রথম ৬ থেকে ৯ মাস করোনাভাইরাস-উত্তর ভ্রমণগুলো চালু হবে। তবে ২০২২ সালের শেষের দিকে ব্যবসায়িক ভ্রমণ মূলত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। যদি করোনা ভাইরাস ২০২২ সালের আগে নিয়ন্ত্রণে আসে তাহলে আগামী ১৬ থেকে ২৪ মাসের (২০২২ সালের পরে) মধ্যে বিমানের সব ফ্লাইট চালু হবে।
অন্যদিকে বিমানের নির্বাহী পরিচালকম-লীর চলতি বছরের সপ্তম ও অষ্টম সভায় বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকৌশল খাতের ব্যয় সংকোচনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিমানের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে ইতিমধ্যে ৬২৮ কোটি টাকা চেয়ে সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোকাব্বির হোসেন। চিঠিতে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বিমানের ক্ষতির কারণগুলো তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, গত দুই মাসে ফ্লাইট বাতিলের পাশাপাশি যাত্রী না থাকার কারণে ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। ওসব ফ্লাইটের যাত্রীদের কোনো ধরনের চার্জ না কেটেই টিকিটের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানে নগদ অর্থ না থাকায় এপ্রিল মাসে কর্মীদের বেতনসহ নানা স্থায়ী খরচ চালাতে ৬২৮ কোটি টাকা প্রয়োজন।