করোনাকালের গল্প
কাঁটা
শান্তা ফারজানা
অলস দুপুর। বারান্দার গাছগুলোতে অনেক সময় নিয়ে পানি দিয়েছে আজ মিরাজ। টবে খুব সুন্দর গোলাপ আর বেলী ফুটেছে আজ। সাদা গোলাপ আর সাদা বেলী। ঢেউ দোলানো ঘ্রাণে অনেক দূরে হারিয়ে গিয়েছিল মনটা তার। ছোটবেলার বন্ধু হিরোর কথা মনে পড়ছে খুব। তারা ঢাকায় একসাথে একই স্কুলে পড়তো। হিরো খুব সুন্দর গিটার বাজাতে পারতো। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই হিরো সিদ্ধহস্ত হয়ে গিয়েছিলো গিটারে। অসাধারণ লাগতো, যখন ও গিটার বাজাতো। মিরাজের মনে হতো বাতাসে ঢেউয়ের দোলক দুলছে। মিরাজের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা পানি। ঝরে পড়লো সাদা গোলাপের সবুজ কাঁটার উপর। কাঁটা থেকে পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো গাছটার কান্ড বেয়ে।
- মিরাজ...।
- আসছি মা। ভেতর থেকে মায়ের ডাকে বারান্দার মোড়া থেকে উঠলো। বেতের মোড়া। উঠলে আর বসলে মচর মচর শব্দ হয়। সে কাঁধের তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছে ভেতরের রুমে গেল।
- জ্বী মা।
- কীরে! তুই দেখি রোদে পুড়ে একদম লাল হয়ে আছিস! যা, যা, শিগগির মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দে। কী অবস্থা!
ভালই হলো। মুখে পানি দেয়ার সাথে সাথে গাল গড়ানো চোখের পানিও ধুয়ে গেলো।
মাগুর মাছ আর শিম আলুর ঝোল। মিরাজের পছন্দের তরকারি। মাগুর মাছের ঝোল পেলে সে দুই তিন প্লেট ভাত একাই সাবাড় করতে পারে। কিন্তু আজ খেতে ইচ্ছা করছে না একদমই। বার বার মনে পড়ছে হিরোর কথা।
সেদিনই হিরোর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। হিরোরা এসএসসি পরীক্ষার পরপরই ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে গিয়েছিল। হিরোর নানার মৃত্যুর পর, মা তার পৈতৃক সম্পত্তিরূপে পাওয়া সেই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাই তারা স্বপরিবারে নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ কৃষ্ণচূড়া এলাকায় চলে যায়। মিরাজ আর হিরোর বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে। আগে যেমন প্রতিদিন দেখা হতো, গল্প গান আর গিটারের টুংটাং শব্দ হতো সেগুলো বছরে একবার করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
"একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি..." এই গানটা গিটারে চমৎকার টিউন করে তোলে হিরো। শুনতে শুনতে যেন ক্ষুদিরামের সেই ফাঁসির মঞ্চে পৌঁছে যায় মিরাজ। মনের অজান্তেই ঝর ঝর করে ঝরতে শুরু করে চোখের পানি।
- এ্যই, কোন কাজ নাই, কর্ম নাই, সারাদিন খালি গান আর গান। রোদে পোড়া, রুক্ষমূর্তির মতো এক নারী দাঁড়িয়ে আছে ছাদের দরজায়।
- কী করতে হবে সোনা বউ...।
হিরোর আদরের কোন মূল্য না দিয়েই অনেকটা সময় নিয়ে নানা আক্ষেপের বয়ান দিলো বউটা। ঘরের খাটটা ঘুণে ধরেছে। কাঁচা মরিচ আছে কিন্তু মরিচের গুড়া নাই, মরিচের গুড়া ছাড়া তরকারি রান্না করলে কেমন সাদা সাদা দেখায়। মোবাইলের চার্জারের কালো তারটা পাশের বাড়ি বিড়ালে কামড়ে একটু ছিড়ে ফেলেছে; ওটা এখন স্কচটেপ দিয়ে লাগিয়ে কাজ চালাতে হয়; এভাবে আর কত, যদি কারেন্ট শক খায়। এসব বিভিন্ন অমূলক কথা এলোমেলো সুরে বলতে থাকে। সামনে বসে থাকা অপরিচিত মেহমানের কথা ভাবেও না একবার। মিরাজ বেশ অপ্রস্তুত বোধ করে। তবে হিরোর দিকে তাকিয়ে থেকে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে চোখ বন্ধ করে স্প্যানিশ গিটারের বেজ'র কাছাকাছি খুব ধীরে বাজাতে থাকে। সেই রাতে দুই বন্ধু ঘুমায়নি। বাসার ছাদে বসে গিটার বাজিয়ে আর গান গেয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল।
মা কাছে এসে মাগুর মাছের মাথাটা মিরাজের প্লেটে তুলে দিতে দিতে বলেন, কী রে বাবা, খাচ্ছিস না কেন? ঠান্ডা হয়ে গেল। বলে আরো দুই চামচ ঝোল দিয়ে যায় প্লেটে। টলটলে ঝোলে ডুবে থাকা ভাত নাড়তে থাকে মিরাজ।
একটা লাশ পড়ে আছে। নীল আর সাদা রঙের চাদরে মোড়া। গোলাপী সবুজ মেরুন ফুলের নকশা আঁকা বাদামী একটা রেক্সিনের উপর পড়ে আছে লাশটা। লাশটার পেটের কাছে চাদরটা দিয়ে গিট বাঁধা। করোনায় মৃত্যু হয়েছে বোধহয় - এই ভয়ে কাছেই এলোনা কেউ। লাশটা তার নিজের বাড়ির গেটেই পড়েছিল। ৯ ঘণ্টা। কেউ এলো না। লোহার গেইটে লোহার তালা ঝুলছে। বাড়ির দরজা জানালা সব আটকানো। ৩০ বছরের তরতাজা প্রাণ, মরে পড়ে আছে নিজেরই বাড়ির সামনে। এই পথ দিয়ে দৌঁড়ে আসতো ছেলেটা।
মা, মা, মা...
মায়ের কানেও লোহার তালা ঝুলছে। মৃত্যুর ভয় কতো ভয়ংকর! এক মুহূর্তে পৃথক করে দেয় আপনজনদেরও।
- ইস্, কাছে যাইস না।
- করোনায় মরছে, করোনায় ধরবো। ধারে যাওন যাইবো না।
- কিন্তু, হিরো বাইয়ের লাশটা এমনি পইরা থাকবো!
- তো, কী করন যাইবো? ঐ লাশ যে গোসল করাইবো হেরও করোনা অইবো আবার যে দাফন করবো হেরও অইবো।
- এডা কোন কথা অইলো! রাখেন আপনাগো ডর ভয়। একজন মানুষ মইরা গেছে তার দাফন দিমুনা? আর হিরো বাই আমাগো দরদের লোক। তারে এবাবে ফালাইয়া রাহা ঠিক হইবো না। আহেন আমার লগে কে কে আছেন? চান মিয়া স্থানীয় মানুষ। মুদির দোকান আছে। তার আফসোসের সূর কানেই তুলল না বাকীরা। সবাই যে যার মতো হেঁটে চলে গেলো। একরকম পালিয়ে বাঁচলো বলা যায়। এভাবে মানুষের চলে যাওয়া দেখে জোব্বা পরিহিত এক হুজুর আসলেন। কে মারা গেছে? ঐ গিটারওয়ালা না?? আরে, এটাই হইলো আল্লাহপাকের গজব। গজব না হইলে নাচা গানা করা মানুষ কেন দুনিয়া ছাইড়া চই্লা যাইবো। তাও আবার এমন দুরারোগ্য রোগে! এই মরার গোসল নাই, জানাজা নাই, সঠিক নিয়মে দাফন নাই। ওয়াতাগফিরুল্লাহ, ওয়াতাগফিরুল্লাহ।
'হিরো লিসান' নামে নারায়ণগঞ্জের সবাই তাকে এক নামে চিনতো। ভালোবাসতো।
হিরো প্রায়ই বলতো, যে নারী গান বোঝে না সে ভালোবাসাও বোঝে না। হিরো একটা মেয়েকে খুবই পছন্দ করতো। হিরো আর লিসা একই বয়সের ছিলো। হিরো একদিন মিরাজকে বলেছিলো লিসার কথা। লিসা হিরোর প্রতিটা ইচ্ছায় প্রণোদনা দিতো। মেয়েটা তার সাথে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে নতুন নতুন টিউন শুনতো। মাঝে মাঝে স্প্যানিশ গিটারের তারগুলোতে আঙুল চালাতো।কিন্তু হিরোর মা বাধা দিলেন।
- সমবয়সী মেয়ে মানে বুড়ি। একটু বয়স হলে আর ভালো লাগবে না। বউ হতে হবে সাত আট বছরের ছোট। নাইলে কী আর মানানসই হয়?
- এগুলা কী বল মা? মানুষ কি কেবল ভোগের জন্য বিয়ে করে? লিসা আর গিটারের বেজ, আমার অন্তরের সুর। ও আমাকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারে।
- হুম, বিয়ের আগে সব মেয়েকেই গিটারের সুর মনে হয়। মোড়ের ফার্মাসির ডাক্তারের খোঁজে একটা ভালো মেয়ে আছে।
লিসার খবর নেয়ার সুযোগ পায়নি। বাবার মৃত্যুর পর মাই হিরোদের মানুষ করেছেন, আগলে রেখেছেন। তাঁর অবাধ্য হতে পারেনি সে। সেদিন কেবল স্যাড সং এর টিউনই তুলেছিল গিটারে।
কয়েকটা দিন ভালো লাগছিলো না শরীরটা। প্রায় সপ্তাহখানেক হলো ভীষণ জ্বর আর খুসখুস কাশি। শ্বাসকষ্ট তার অনেক আগের সমস্যা। জ্বরের সাথে সাথে বেড়ে গেলো শ্বাসটান। হিরোকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখান থেকে তাকে চিকিৎসা করানো হলো, ওষুধ নিয়ে বাসায় নিয়ে এলো তার পরিবার। করোনার ভয়ে এই কয়টা দিন হিরোর কাছেই যায়নি তার স্ত্রী। অন্য রুমে ঘুমিয়েছে। প্রয়োজনীয় যতেœর অভাব হয়েছিল হিরোর।
আল্লাহু আকবর,
আল্লাহু আকবর।
আস্সালাতু খাইরুম মিনান নাওম
আস্সালাতু খাইরুম মিনান নাওম।
মঙ্গলবার ভোরে ফজরের আযান শুনতে শুনতেই মৃত্যু হয় হিরোর। মরার সময়েও প্রিয় নীল গিটারটা খুঁজছিলো সে।
প্যাঁ পোঁ... প্যাঁ পোঁ।
বিকট আর্তনাদধ্বনি নিয়ে বাড়ির গেইটে
দাঁড়িয়ে থাকে অ্যাম্বুলেন্স। বাসা থেকে তার মরদেহ ওঠানোর চেষ্টা করলে আশপাশের লোকজন বাধা দেয়।
- হায় হায়, এতো মইরা গেছে। এরে লইয়া কই যান?
-মইরা গেছে? কেঁপে উঠে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার। ভাই কী হইছিলো?
- ভাই, জ্বরে কাশিতে ভুগতাছিল সপ্তাহ দশদিন। হাসপাতালেও আনছে নিছে। কী অইসে আল্লাহ মালুম!
- কী আবার অইবো, করোনায় ধরসে।
-করোনা! মরদেহ ফেলে রেখেই চলে যান আতংকিত চালক। পরিবারের লোকজনও পিছিয়ে যায়। মরদেহ ধরতেও আসেনা। সবাই পালিয়ে যায় যে যার মতো। বাড়িতে তালা লাগিয়ে দেয় পরিবারের লোকজন। বউটা একবারের জন্য উঁকিও দেয় না।
ভোরের সূর্য উঠে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যায়। সোনালী সকালে লকডাউন নারায়ণগঞ্জে নিজের বাড়ির সামনে পড়ে থাকে লাশটা। আস্তে আস্তে বেলা বাড়ে। রাস্তায় দু একটা উৎসুক মুখ উঁকি দেয় এলোমেলো চোখে। পানি মোছে নীরবে। ধীরে ধীরে ঠিক দ্বিপ্রহরে সময়ে ছায়া দ্বিগুণ হয়। মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসে আযানের সুর। আরো দুই ঘণ্টা তিন ঘণ্টা লাশটা পড়ে থাকার পর
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে লাশ দাফনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
প্রিয় বন্ধু হিরোর মৃত্যুর সংবাদটা অনলাইন পত্রিকায় পড়ে বিমর্ষ হয়ে যায় মিরাজের মন। মাগুরের মাথাটা রেখেই উঠে যায় টেবিল থেকে। অনেক সময় নিয়ে হাত ধোয়, ভেজা হাত তোয়ালেতে মোছে। বন্ধুর সাথে কাটানো দিনগুলোতে ভাসতে থাকে কেবল। বড্ড অসহায় মনে হয় নিজেকে।
মিরাজের কানে কেবলই বাজতে থাকে হিরোর নীল গিটারের মায়াঝরা টিউন
"এতো বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে..."
শান্তা ফারজানা : মহাসচিব, সেভ দ্য রোড
কারোনাকালের কবিতা
বন্দীপ্রণয়
মোমিন মেহেদী
উহানে নেমেছে ছন্দপতন
নেমেছে ছলছল চোখের পর্দা
অরিত্রি সন্ধ্যায় গেন্দাফুলের ঘ্রাণ
নাকের ভাজে ভাজে জমেছে সুবাস
তুমি মেয়ে হয়ে মেঘে ভেসে থাকো
আমি চেয়ে দেখি ক্ষয়ে যাওয়া বিবেকের হাঁটা
টিমটিমে কুপির আয়েশে সুখ জড়ো করে ঋণ
দিন নেই, রাত নেই, বন্দীপ্রণয়।
অভয়ের দরোজা বন্ধ
অন্ধ হয়ে ওঠে ঠোঁটের আদর
তুমি বুঝি জোঁকের পরবর্তী ভার্সন
নীতির বাইরে রাখা পাখি আজ যখন তখন
উড়ে যায় দুর্নীতি হয়ে; রয়ে সয়ে আধাসেদ্ধ
বেগুনে বিবেক করো জড়ো। বড় বেশি স্বার্থপর তুমি
আমি-আমরা সবাই...
অপ্রাপ্তসকাল
মোমিন মেহেদী
শুকনো রুটির সাথে গুড়হীন দিন কাটে
কেটে যায় বিবেকের দেহ।
হয়রান ধর্মবাজী-দুর্নীতির রাঘববোয়াল।
মেয়োনিজে জীবনের স্বাদ নেয় অপ্রাপ্তসকাল
লোলুপ হাতগুলো দেয়ালের আড়ালে করে নিসপিস
সোহাগেও গড়ে উঠেছে বিবেধ
স্বার্থপর পৃথিবী আজ যাকে তাকে করে সন্দেহ
তীর বিঁধে বকগুলো করে কান্নামিছিল
পিছিল সময়ে আলো গলে গলে পড়ে
ঘরে নেই কারো কারো দুমুঠো আয়েশ
কারো আছে অতিবেশি সুখের রেশম
মানুষে মানুষে স্বার্থপর খেলা; পশুদের
দয়াবান হয়ে ওঠার বেলা যেন চলছে এখন।
সীমাহীন সীসা আর স্বর্ণরেণু
বেনুর বিকেলগুলো ফেরাতে পারে না।
তবু বারবার কারবার রেখে ছোটে তামাটে দুহাত...