অসাধু সিন্ডিকেট করোনার সুযোগ নিয়ে মৌসুমের শেষে এসে চালের বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। অনেক অটোরাইস মিল মালিকের কাছে ধান থাকলেও তারা মিল চালাচ্ছে না। বরং ধানের মজুদ শেষ এবং পরিবহন জটিলতা ও শ্রমিক না থাকার দোহাই দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা বোরো মৌসুম শুরুর আগেই চালের বাজার অস্থির করে ফায়দা লুটের চেষ্টা করছে। গত কয়েকদিন ধরেই দেশের অধিকাংশ অটোরাইস মিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে বাজারে চালের কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। করোনার তা-বের মধ্যে গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা। চাল ব্যবসায়ী এবং খাদ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ মূলত কতিপয় মিল মালিক ব্যবসায়ীর হাতে। ওসব ব্যবসায়ীর গুদামে এখনো বিপুল পরিমাণ ধানের মজুদ রয়েছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তারা চালের মিল চালাচ্ছে না। মিল মালিকরা মিল সংলগ্ন যে গুদামে ধান রাখে কেবল ওসব গুদামে কি পরিমাণ ধান রাখে তার হিসেব সরকারকে দিয়ে থাকে। ওসব গুদামে হানা দিলে ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু অন্য গুদামের কোনো হিসেব সরকারের কাছে থাকে না। ফলে অন্য গুদামগুলো নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে। যাতে বিপুল পরিমাণ ধান মজুদ রাখা হয়। তাছাড়া চাল পরিবহনের জন্য ওসব ব্যবসায়ীদের কারোর কারোর বিপুলসংখ্যক ট্রাকও রয়েছে। কিন্তু ওসব ট্রাককে এখন চাল নিয়ে ঢাকায় আসতে দেয়া হচ্ছে না।রাজধানী ঢাকার চালের বাজারের বেশিরভাগ কুষ্টিয়া থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু মিল না চলার পাশাপাশি ঢাকায় পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় চালের দাম অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানায়, মৌসুমের শুরুতে মিল মালিকরা যখন ধান কেনে তখন এক কেজি চালের উৎপাদন খরচের সঙ্গে মুনাফা যোগ করার পর ৩৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে। কিন্তু এখন ওই চাল মিল গেটেই ৩৮ থেকে ৩৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে কেজিপ্রতি আরো তিন টাকা বেড়ে যাচ্ছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে কঠোরভাবে চালকল মালিকদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি দাম নির্ধারণ করে দেয়া জরুরি। যাতে কেউ বেশি দামে চাল বিক্রি করতে না পারে। কিন্তু বাস্তবে ওই উদ্যোগই নেই। এই সুযোগে চালকল মালিকরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো সরু চালের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। করোনা ভাইরাসে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে প্রকার ভেদে মোটা চালের দর ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। কিন্তু এই সময়ে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ৪২ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ কেজি প্রতি চালের দাম বেড়েছে ৮ টাকার মতো। আর সরু লম্বা চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। বাজারে বর্তমানে মিনিকেট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, নাজির শাইল প্রকার ভেদে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, আবার ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ৬৫ থেকে ৭০ টাকা হয়েছে। খুচরা বাজারে কোথাও কোথাও এর থেকে বেশি দামেও চাল বিক্রি হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকারিভাবে দেশে শুধুমাত্র মোটা চাল সংরক্ষণ করা হয়। বাজারে মোটা চালের ভোক্তা নির্দিষ্ট শ্রেণীর গ্রাহক। ফলে বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারিভাবে কম মূল্যে যে চাল বিক্রি করা হয় তার গ্রাহকও নির্দিষ্ট। তারা কেউ সরু চাল খায় না। ফলে মোটা চালের দাম কমলেও বাজারে সরু চালের দাম দাম কমে না।
এদিকে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্বেই কৃষি উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছে। তাতে করে করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে আসন্ন বোরো মৌসুম এবং সামনের আউস মৌসুম খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই দুই মৌসুমে দেশে চাহিদার উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন না করা গেলে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে এমন সঙ্কট সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে খাদ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা চাল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। তাদের অভিমত, বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারিভাবে মোটা চালের পাশাপাশি সরুচাল সংরক্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া উচিত। বর্তমানে দিনাজপুর জেলার ১৮৯টি মিলের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মিল বন্ধ রয়েছে। আর ওসব মিল বন্ধর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা শ্রমিক না পাওয়ার অৎুহাত দেখাচ্ছে। তারা বলছে, করোনার কারণে শ্রমিকরা মিলে কাজ করতে চাইছে না। পাশাপাশি ধানের সঙ্কট থাকায় প্রতিদিন একটি মিল যে পরিমাণ উৎপাদন করতে পারে, তার অর্ধেকও উৎপাদন করছে না। অর্থাৎ ওই জেলায় প্রতিদিনের চালের উৎপাদন আগের তুলনায় ২৫ ভাগে নেমে এসেছে। মূলত চালকল মালিকরা বোরো ধান হাতে পাওয়ার আগেই একটি বড় ফায়দা লুটের চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে চালের বাজারের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে অটোরাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী জানান, চালের দাম বাড়ার একক দায় মিল মালিকদের নয়। বর্তমানে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি পরিবহন জটিলতা রয়েছে। আবার মৌসুমের শেষের দিকে ধানের সঙ্কটও রয়েছে। এসব কারণে মিল চালানো সম্ভব হচ্ছে না। দেশে ৫৫০টি অটোরাইস মিল রয়েছে কিন্তু এখন তার মধ্যে ২০০ থেকে ২২৫টি চলছে। মিল মালিকরা চালের দাম ৫০ পয়সা কেজিতে বাড়ালে খুচরা ব্যবসায়ীরা ৫ টাকা বাড়ায়। এসব যাদের দেখার কথা তারা তা দেখে না। এককভাবে মিল মালিকদের ওপর দায় চাপানো হয় সমীচীন নয়।
এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) মনোয়ার হোসেন জানান, কুষ্টিয়াতে ৪৬টি অটোরাইস মিলের মধ্যে এখন মাত্র তিন থেকে চারটি চলছে। বাকি সবগুলো বন্ধ রয়েছে। যেখানে প্রতি দিন ৯০০ টন চাল উৎপাদন হতো, এখন সেখানে উৎপাদন ৭৫ টনে নেমে এসেছে।
একই প্রসঙ্গে নওগাঁও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জিএম ফারুক হোসেন পাটোয়ারি জানান, তার এলাকায় ৫৩টি অটোরাইস মিল থাকলেও তার মধ্যে এখন ২৭টি মিল চলছে। বাকিগুলো বন্ধ রয়েছে। মৌসুমের এই সময়ে রমজানের আগে কিছু কিছু রাইস মিল মুড়ির চাল উৎপাদন করে। ফলে স্বাভাবিক চালের উৎপাদন আরো কমে যায়। মিল বন্ধ থাকাতে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি হবে।