দেশে আমিষ যোগানদাতা খাত পোল্ট্রি ও দুগ্ধ শিল্প চরম সঙ্কটে পড়েছে। করোনার প্রভাবে চাহিদা কমে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর করোনার কারণে লকডাউন যতো দীর্ঘতর হচ্ছে ওসব শ্রমঘন ওসব শিল্পের সঙ্কটও ততো বাড়ছে। ইতিমধ্যে ওসব শিল্পের উদ্যোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে ওসব শিল্প সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ ব্যক্তির কর্মসংস্থান। এমন অবস্থায় আমিষের জোগান নিশ্চিতে ওই দুটি খাতকে এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্টরা সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছে। পোল্ট্রি এবং দুগ্ধ খামার সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান অবস্থায় প্রায় পথে বসার অবস্থায় চলে গেছে দেশের অনেক পোল্ট্রিশিল্প খাতের ক্ষুদ্র খামারি। একই ভাবে দুগ্ধশিল্প খাতের প্রান্তিক খামারিরাও মহা বিপাকে রয়েছে। তাদের উৎপাদিত দুধ বিক্রি করার মতো ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক খামারি আত্মীয়-স্বজন কিংবা গরিব মানুষকে বিনা মূল্যে দুধ দিচ্ছে। কেউ কেউ দুধের দাম না পাওয়ায় মাটিতেও ফেলে দিচ্ছে। এমন অবস্থায় ব্যবসা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে পোল্ট্রি ও দুগ্ধ খাতের উদ্যোক্তা ও প্রান্তিক খামারিরা।
সূত্র জানায়, করোনার আঘাতে পোল্ট্রিশিল্পে বড় ধস নেমেছে। বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে ওই শিল্পের ডিম, বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগি। মুরগির দাম কমে যাওয়ার পাশাপাশি এক দিন বয়সী বাচ্চার দামও কমেছে। উৎপাদন থাকলেও চাহিদা কম থাকায় পাইকারি পর্যায়ে ডিমের দাম কমে গেছে। ব্রয়লার মুরগির দামও তলানিতে নেমেছে। বিক্রির দামের চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি হওয়ায় খামারিরা বড় লোকসান গুনছে। পাশাপাশি সঙ্কটময় মুহূর্তে পোল্ট্রি খাবারের দাম বাড়তির দিকে। ফলে উৎপাদনের ব্যয় বাড়লেও উদ্যোক্তা ও খামারিরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। এই অবস্থা চলতে থাকলে পোল্ট্রিশিল্পের খামারিরা বড় লোকসানে পড়বে। আর এই ক্ষতির কারণে খামারিরা মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশ আমিষের চাহিদা পূরণে সঙ্কটে পড়বে। একইভাবে করোনাভাইরাস দেশে দুগ্ধশিল্পে বড় অশনিসংকেত নেমে এসেছে। লকডাউনের কারণে কার্যত ঘরবন্দি প্রান্তিক মানুষ পড়েছে খাদ্য সংকটে। এই অবস্থায় বেঁচে থাকতে খাবারের জোগানই যেখানে কষ্টকর, সেখানে দুগ্ধজাত খাবার মানুষের কাছে অনেকটাই পরিহাস। এ কারণে দুগ্ধজাত পণ্যেরও চাহিদা কমে গেছে। দুধ উৎপাদন বাড়লেও পণ্যের বিক্রি না হওয়ায় তা অবিক্রীত থাকছে। তাতে লোকসানে পড়েছেন প্রান্তিক খামারিরা। বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ দুগ্ধ খামার রয়েছে। সেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। তাদের জীবন-জীবিকা দুগ্ধশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। দেশে দুধের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৯৯ লাখ টন। বর্তমানে বিপুল পরিমাণদুধ অবিক্রীত থাকছে। টাকার হিসাবে প্রতিদিন দুগ্ধ খাতে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, করোনা ভাইরাসের কারণে কৃষি খাতে প্রণোদনা হিসেবে সরকার স্বল্প সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কৃষি খাতে গ্রাহক পর্যায়ে এই ঋণ নিতে পারবে। সর্বোচ্চ সুদহার ৫ শতাংশ। এই তহবিল থেকে গ্রামাঞ্চলে যারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষি; তাদের ঋণ দেয়া হবে। কৃষি, ফুল, ফল, মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি ফার্ম ইত্যাদি কর্মকা-ে সংশ্লিষ্টরা এ সহায়তা পাবে। ফলে খামারিদের বড় অংশই এই ঋণ সুবিধা নিতে পারবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। তবে তাদের মতে, অনেক প্রান্তিক খামারির পক্ষেই ব্যাংক হিসাব পরিচালনার সক্ষমতা নেই কিংবা ঋণ নিতে ব্যাংককে যেসব কাগজপত্র দিতে হয় সেগুলো বড় অংশই তাদের নেই। ওই হিসেবে স্বল্প সুদে নয়, বিনা সুদে ঋণ দিলেও খামারিরা ওই সুবিধা নিতে পারবে না। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিদের তাৎক্ষণিক সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে ছোট খামারিদের টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
এদিকে পদশের প্রান্তিক পর্যায়ের চাষী, খামারি এবং উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত মাছ, দুধ, ডিম ও পোল্ট্রি বাজারজাত করার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। করোনা পরিস্থিতিতে বাজারজাতকরণ সঙ্কটে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ উৎপাদক, খামারি ও উদ্যোক্তাদের কথা মাথায় রেখে এবং ভোক্তাদের প্রাণিজ পণ্য প্রাপ্তির চাহিদা বিবেচনা করে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন, উদ্যোক্তা ও খামারিদের সহযোগিতায় স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে এ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। করোনা সংকটে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উৎপাদিত প্রাণিজ পণ্যের সুষম বন্টণের বিষয়টি মাথায় রেখে ইতিমধ্যে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ও জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পিকআপ, কুল ভ্যান ও অটোরিক্সাযোগে প্রান্তিক পর্যায় থেকে দুধ ও ডিম সংগ্রহ করা হচ্ছে। একইসাথে প্রচার-প্রচারণাপূর্বক শহরের গ্রোথ সেন্টার ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র চালু করে দুধ ও ডিম নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে ভোক্তাদের আস্থা অর্জন ও বিশুদ্ধ দুধের নিশ্চয়তা প্রদানে ভেটেরিনারি সার্জন, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর এবং ভেটেরিনারি কম্পাউন্ডারের সমন্বয়ে ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাকরণ টিমও গঠন করা হয়েছে। তাতে খামারি ও উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ভোক্তাগণ উপকৃত হচ্ছে।
অন্যদিকে পোল্ট্রিশিল্পের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মনজুর মোরশেদ খান জানান, করোনা ভাইরাস পোল্ট্রিশিল্পে বড় ধরনের আঘাত করেছে। এই আঘাতে পোল্ট্রিশিল্পে বড় ধস নেমেছে। মাংস, ডিম ও বাচ্চা উৎপাদনে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে এই শিল্প। ছোট ছোট খামারি এখন ধ্বংসের মুখে। অথচ এমন পরিস্থিতিতেও বড় ফার্মগুলো নিজেদের মধ্যে অসাধু প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। একচেটিয়া বাজার তৈরি করতে তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বাজার দখলে এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে ছোট ও মাঝারি খামারগুলো প্রায় ধ্বংসের মুখে। বড় শিল্পগুলো এখন ছোট শিল্পগুলোকে খেয়ে ফেলছে।
একই প্রসঙ্গে দুগ্ধ শিল্প প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. শাহ এমরান জানান, করোনার কারণে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বড় কোম্পানিগুলো প্রান্তিকক পর্যায় থেকে দুধ নেয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার যে কৃষি খাতে স্বল্প সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, ওই ঋণ পেতে ব্যাংকে মর্টগেজ দেয়ার মতো কিছু অনেক খামারিরই নেই। অনেকের কেবল গরুই সম্বল। এ অবস্থায় তারা কিভাবে এই ঋণ নিতে পাবে। আর যারা প্রান্তিক খামারিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ওসব বড় খামারিরাই ঋণের সুবিধা নেবেন। প্রান্তিক খামারিরা রয়ে যাবে লোকসানেই। এ অবস্থায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রান্তিক খামারিদের স্বল্প মেয়াদে গাভিপ্রতি আর্থিক সহায়তা, সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য আগামী ৩ মাস বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফ করা যেতে পারে। পাশাপাশি দেশের দুগ্ধশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দীর্ঘ মেয়াদে বিনা সুদে খামারিদের ঋণ সুবিধা, প্রতিটি উপজেলায় খামারিদের দুধ, মাংস ইত্যাদি সংরক্ষণের মাধ্যমে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নিজস্ব হাট/বাজার তৈরির মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা গেলে খামারিরা টিকে থাকবে।