কারোনাকালে-লকডাউনে নির্মম মানবিক পতন নির্মিত হয়েছে গত কয়েক মাসে। সারাবিশ্বে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক কষ্ট-বেদনায় আশার বাতি নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাস- নৈরাজ্য-দুর্নীতির রাম রাজত্ব তৈরি হয়েছে ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে। আর এখন নির্মমতায় অন্ধকারের রাস্তায় অগ্রসর হচ্ছে এই স্বাধীন মানচিত্র। দেশ বাঁচানোর চেষ্টা নেই কারো মধ্যে, নেই মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা। যা আছে তা কেবল লোভ আর লোভ। এই লোভের রাস্তায় অগ্রসর হচ্ছে স্বয়ং দেশের চালিকা শক্তি। যে কারণে নির্মমভাবে অর্থনৈতিক ধ্বসের মুখে, দুর্ভিক্ষের মুখে, ক্ষয়ে যাচ্ছে দেশের সকল সম্ভাবনা। কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে জিডিপি। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীরা একেক রকম কথা বলছেন। করোনার এ মহামারীতে অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি এখনই বলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য করোনা কতদিন স্থায়ী হয় তার ওপর নির্ভর করছে সব। বিশ্বব্যাংক বলেছে এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২-৩ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে ২ শতাংশে নেমে যেতে পারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অবশ্য বলেছে- করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা গেলে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাবে বলা হয়েছে - প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বিতর্ক থাকলেও করোনায় প্রবৃদ্ধি যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসের অবস্থা ভালো থাকলেও বর্তমানে করোনার কারণে সব কিছুই বন্ধ রয়েছে। বাস্তবতা হলো এই যে, প্রথম ৮ মাসের সঙ্গে শেষ ৪ মাসের হিসাব একেবারেই মিলবে না। তাই আমরা প্রতিবছর প্রাথমিক একটি হিসাব তৈরি করলেও এ বছর করিনি। তবে একথা বলতে পারি, এ অর্থবছর প্রবৃদ্ধির হার কম হবে; একইভাবে ১২ এপ্রিল ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তবে তা নির্ভর করছে করোনা কতটা দীর্ঘায়িত হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অর্থনীতির নগণ্য কর্মী হিসেবে বলতে পারি যে, করোনার কারণে অবশ্যই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বব্যাংক ২-৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলেছে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে অনেক দেশের নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। করোনা দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নেগেটিভ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএসএফ) জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক-২০২০, দ্য গ্রেট লকডাউন’ প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের ২০২০ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ পূর্বাভাস দেয়। তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে এ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি জোরালোই থাকবে, আর না পারলে লকডাউনের রেশ ধরে ধ্বংস নেমে আসবে ভয়াবহভাবে আমাদের অর্থনীতিতে।
সেই সাথে আছে চরম মানবিক বিপর্যয়। আর তার হাত থেকে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজন সরকারের সর্বোচ্চ সহযোগিতা। তা না হলে করোনাকালেই মানুষের আত্মহত্যা, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু সহ কমপক্ষে ১০ ভাবে ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুও ঝুঁকি। কেননা, এরই মধ্যে জানতে পেরেছি- বড় ধরনের অসুখ-বিসুখ, দুর্ঘটনা কিংবা মারাত্মক কোনো বিপদ-আপদে আকস্মিক মোটা অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হলে যাতে কারও কাছে হাত পাততে না হয়, সে জন্য চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ তিল তিল করে যে ক্ষুদ্র সঞ্চয় গড়ে তুলেছেন, মরণব্যাধি করোনা এবার তাতে ভয়াল থাবা বসিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি, গার্মেন্টসহ সব ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শপিংমল, মার্কেট ও গণপরিবহণ দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ থাকায় চাকুরেদের পাশাপাশি পেশাজীবী মানুষও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ তাদের সঞ্চয় ভেঙে খেতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে কারও কারও সঞ্চয় শেষ হওয়ার পথে। আবার খুদে ব্যবসায়ীদের অনেকের সঞ্চয় শেষে পুঁজিতে টান পড়েছে। তার উপর বাড়িয়ালাদের চাপ পড়ায় অবিরত তৈরি হচ্ছে সংকট। আমি মনে করি- করোনা পরিস্থিতির কারণে কর্মক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা আরও দীর্ঘমেয়াদি হলে দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের খুদে সঞ্চয়ের পুরোটাই শেষ হয়ে যাবে। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের বিত্তশালী আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয় পর্যায়ে চড়া সুদে ঋণ প্রদানকারী বিভিন্ন সমবায় সমিতি কিংবা সুদি মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হবে। তাদের অনেকের বাড়ি ভাড়া, ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজের টিউশন ফি, হাউস টিউটরের বেতন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল বকেয়া পড়বে, যা পরবর্তীতে সহজে পরিশোধ করাও তাদের জন্য দুষ্কর হবে। কেননা, করোনার প্রকোপ কেটে গেলেও নানা প্রতিবন্ধকতা ও সংকটে কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়বে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাকুরে ও পেশাজীবীদের একটি বড় অংশের বেকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে, আর তার জন্য না আছে সরকারি কোন পদক্ষেপ, না আছে আমাদের তথাকথিত এনজিও বা বেসরকারি কোন পদক্ষেপ।
বরং বাস্তবতা হলো- মধ্যবিত্ত বা নি¤œ মধ্যবিত্ত যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন, সাধারণত চলতি মাসের মাঝামাঝিতে আগের মাসের বেতন পান। মাসের প্রথমভাগের সময়টুকুতে তারা স্থানীয় মুদি দোকান থেকে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাকিতে কেনেন, যা বেতন হাতে পাওয়ার পর পরিশোধ করেন। বাড়ি ভাড়া, ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজের টিউশন ফি, হাউস টিউটরের বেতন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিলও তারা বেতন পাওয়ার পর পরিশোধ করেন। সংসারের সব ধরনের খরচ মেটানোর পর সামান্য যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে তা তারা তিল তিল করে জমিয়ে ছোটোখাটো সঞ্চয় গড়ে তোলেন। যা ছেলেমেয়েসহ পরিবার-পরিজনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য ব্যাংক, সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাকঘর কিংবা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পে বিনিয়োগ করে আসছিলেন। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক খাতে বড় ধাক্কা লাগার পর চাকরিস্থলসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে বেতন-ভাতা পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় ভেঙে জীবন নির্বাহ করতে হচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রেই সেই সঞ্চয় শেষ হয়ে অভূক্ত কাটাতে হচ্ছে দিন। সরকারের ত্রাণ প্রণোদনা কেবল টিভির পর্দায় আর প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ পর্যন্তই; তাদের কপালে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এমতবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজে যাওয়ার ব্যবস্থা করা না হলে লকডাউন নামক ফাঁদে দেশ পড়বে ভয়াবহ রকম মৃত্যুজোয়ারে। একদিকে করোনামৃত্যু; অন্যদিকে অভূক্ততার কারণে নির্মমভাবে বাড়বে অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যুমিছিল; সাথে থাকবে বিভিন্ন ধরনের ঋণের বোঝায় আক্রান্ত মানুষের হতাশামৃত্যুও। যার কোনটাই চাই না বলে লিখছি- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব ত্রাণ-প্রণোদনা আর আশার বাণীর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিভাবে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সচল করা যায়, সেই রাস্তায় অগ্রসর হোন; দেশ বাঁচান-মানুষ বাঁচান...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি