বাংলাদেশের আলোমানুষ, সাহস-সুন্দর-স্বচ্ছমানুষ, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন কিন্তু সাহিত্য-গবেষণা, লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে স্মরণিয় হয়ে থাকবেন। তিনিই একমাত্র মানুষ স্বাধীনতার ৪৯ বছরে রাজনীতিতে নাম না লিখিয়েও অ-নে-ক বড় উপকার করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার পরপর ৩ বারের সরকারের-আওয়ামী লীগের-মহাজোটের।
তিনি এতটাই বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন যে, একবার নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘পূর্ববাংলার একটি মহকুমা শহরের বড় হওয়া মানুষ। কলকাতায় রাজনীতি করতেন। এবং সেখানে সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করেছেন। দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন। দাঙ্গার সময় মুসলমান মেয়েদের উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে এসেছেন। আবার হিন্দু শিক্ষককে নিরাপদে এলাকা পার করে দিয়েছেন। এই যে নানা রকম দিক তার। একদিনে তো গড়ে নাই। তিলে তিলে নিজেকে তৈরি করেছেন তিনি আসলে। এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিত। এই যে তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা'- এগুলো পড়লেই তো বোঝা যায়, কেমন দরদি মানুষ। এগুলো তো ওঁর চরিত্রের অপরিহার্য দিক। মানুষের জন্য তার যে অনুভূতি, মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য, তার কল্যাণ করার জন্য চেষ্টা, এইটা একদম বানানো ব্যাপার নয়। এটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরের ব্যাপার নয়। এটা একেবারে প্রথম থেকেই। কাজেই বলা যায় যে, নেতৃত্বের গুণ ছিল এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষকে সেবা করার সম্পূর্ণ চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধুর। মানুষকে সেবা করতে করতেই তো তিনি প্রাণ দিলেন।’
এত শ্রদ্ধা দেশের স্থপতির জন্য কেবল তিনিই নিবেদন করেছিলেন। যে কারণে সবসময় আলোর পথপ্রদর্শক হিসেবে বিশ্বব্যাপী তিনি নিরন্তর রাজবোদ্ধা-কাজযোদ্ধা। প্রিয় শিক্ষাজন আনিসুজ্জামানের রচিত ও সম্পাদিত বহু বাংলা ও ইংরেজি বই, শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্ব বহন করে। সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ভাবনার ক্ষেত্রে চেতনার বাতিঘরের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। নিবেদিত একজন শিক্ষক, একজন সমাজ-মনস্ক মানুষ, প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী একজন অনন্যসাধারণ মানুষ হিসেবে তাকে আমরা সব সময় বিবেচনা করি। ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্ম-শতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। দেশের প্রতিটি সংকটকালে তাঁর বক্তব্য, মন্তব্য এবং ভূমিকা দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। প্রিয় এই মানুষ-শিক্ষাগুরু ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ৪৭-এর দেশভাগের পর তাঁর পরিবার প্রথমে বাংলাদেশের খুলনাতে আসেন। পরে ঢাকায় স্থায়ী হন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও ১৯৫৭ সালে এম.এ. পাস করেন। এরপর মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলছিলেন বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতির অভিধানসহ যেকোন প্রকল্পে তাঁর অবদান ছিল সীমাহীন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান রেখেছেন ড. আনিসুজ্জামান। ১৯৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান বাংলা ভাষায় অনুবাদের যে কমিটি ছিল সেটার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশকে কতটা ভালোবেসেছেন তিনি তাঁর প্রমাণ দিয়েছেন- ১৯৯১ সালে গঠিত গণ আদালতের একজন অভিযোগকারী হয়ে। বাংলা ভাষার উপর দখল থাকার ব্যাপার না, পুরো বাংলাদেশের স্পিরিটটা, মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, সংবিধানে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের তাৎপর্য, উৎপত্তি বোঝার মত যে ক্ষমতা থাকা দরকার সেটার অভাব মেটাতে পেরেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ,একুশে পদক সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আলোকিত এই মানুষটি এতটাই দেশপ্রেমিক ছিলেন যে, জীবনের বাঁকে বাঁকে বলেছেন- দুটো কাজের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। একটা হচ্ছে সংবিধানের কথা বললাম, আর একটা হচ্ছে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশনে, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা। শিক্ষা কমিশন গঠন হওয়ার পর এর উদ্বোধন হতে অনেক সময় নিয়েছিল। কারণ তখন ছাত্ররা বলছে- শিক্ষা কমিশনে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। এটা নিয়ে একটা অচল অবস্থা। শিক্ষা কমিশনের উদ্বোধন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু একটা লম্বা বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার পরে তিনি বললেন, আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করেন। আমি দুটো প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম যে, আমাদের জাতীয় আয়ের কতভাগ শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হবে? এটা যদি সরকার আমাদের বলে দেয়, তাহলে আমরা সেই মতো সুপারিশ করতে পারি। আর বলেছিলাম যে, শিক্ষা কমিশন সরকার গ্রহণ করুক বা না করুক, এর দ্বিমত পোষণকারী মন্তব্যসহ এটা ছাপতে হবে। বঙ্গবন্ধু প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বললেন যে, আপনারা টাকা-পয়সার কথা ভাববেন না। আমি ভিক্ষা করে হলেও টাকা-পয়সা জোগাড় করে দেব। কিন্তু আমি চাই যে দেশের জন্য একটি ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে। আপনারা আপনাদের সাধ্যমতো একটা ভালো ব্যবস্থার কথা বলেন। আর কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করার ব্যাপারে উনি বললেন যে, বাংলাদেশ সরকারের কিছুই তো গোপন থাকে না; সবই প্রকাশ হয়ে যায়। এটাও হবে। আমি বললাম- না, ওই রকম প্রকাশ চাই না। সরকারিভাবেই প্রকাশ হলে চলবে। এ তো '৭২ সালের কথা বললাম। '৭৪ সালের মে মাসে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে কমিশনের সব সদস্য রিপোর্ট দিতে গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু এলেন এবং আরম্ভ করার আগেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যে, তুমি সবার শেষে আমার সঙ্গে দেখা করে যেও। বললাম, আচ্ছা। যখন দেখা করতে গেলাম, উনি বললেন- তোমরা নাকি এমন রিপোর্ট তৈরি করেছ, যেটা বাস্তবায়ন করতে গেলে আমার পুরো বাজেট চলে যাবে। আমি বললাম, আপনি কি পড়েছেন পুরো রিপোর্ট? বললেন, আমার পড়ার সময় কোথায়? আমাকে আমলারা যা বলেছে, আমি তার থেকে বলছি। আমি বললাম যে, এটা ঠিক না; সব স্কুলেই লাইব্রেরি থাকা দরকার। আমরা আর্থিক বিবেচনায় বলেছি, ইউনিয়ন পর্যায়ে লাইব্রেরি থাকবে। এই কথাবার্তা হলো। বঙ্গবন্ধু যখন মস্কো থেকে ফিরে এসেছেন, অসুস্থ ছিলেন কিছুদিন। তো, আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, কেমন আছেন? উনি বললেন যে, আমি ভালো নেই, আমি মস্কো থেকে চলে এলাম চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে। তার কারণ যখন শুনলাম যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে সাতজন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে, তখন আমি আর ওখানে থাকতে পারলাম না। বললাম যে, দেশে আপনি বিশ্রাম নেন। বললাম যে, ঢাকায় বিশ্রাম নেন। বললেন- কীভাবে নেব? লোক তো আসেই সব সময়।
আমি বললাম যে, ঢাকার বাইরে যান; লোককে দেখা দেবেন না। তখন তার চোখে প্রায় পানি চলে আসছে। বলছেন যে, লোককে খেতে দিতে পারছি না, পরতে দিতে পারছি না। এখন যদি দেখা দিতে না পারি, তাহলে আর আমার কী থাকবে! এইটা একটা আবেগের কথা। কিন্তু একেবারে প্রাণের কথা। ওই দিনই উনি আমাকে বললেন যে, কবীর চৌধুরী তখন শিক্ষা সচিবের দায়িত্বে আছে। উনি ওটা ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন। উনি বললেন যে, আমি চাই তুমি শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব নাও। বললাম যে, আমি পারব না। প্রথমত, এই কাজ আমার নয়। দ্বিতীয়ত, আমি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছি, আমাকে ঘুরে আসতে দিন। বললেন যে, ভাবো আর কালকে এসে আবার বলো। তো আমি বললাম, তারপর বললেন যে- আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও বিলেতে, তারপর ফিরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে চাটগাঁও যাবে বা যেখানে যাবার যাবে। আমি ফিরে এলাম '৭৫ সালের ১১/১২ আগস্টে। ১৫ তারিখে তো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেই গেল। আমি আর ওঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগও পেলাম না।’
বঙ্গবন্ধুকে কেউ অবমূল্যায়ণ করলে লোভ মোহহীন নিরন্তর তিনি প্রতিবাদী। আর তাই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ইতিহাস নির্মাণ করে নিজেই ইতিহাস হয়ে গেছেন। উপমহাদেশে সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি একটি জাঁতি নির্মাণে অংশ নিয়েছেন। এমন বর্ণাঢ্য জীবনের দেখা মেলে না সচরাচর। সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে তিনি শেকড়ের সন্ধান করেছেন। তিনি জাতীয় জীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে আমাদের বাতিঘর। আর এই বাতিঘরের চলে যাওয়ায় আজ সবচেয়ে ব্যথিত তরুণরা। যারা নতুনধারার রাজনীতি করে, যারা দেশকে ভালোবাসে-স্বাধীনতায় হাসে। শোক তাদের শক্তি হোক, কাটুক করোনাকালের দুঃসময়-অভয়ের রাজনীতি নিয়ে অবারিত তারুণ্যের সাথে তাই দিনে রাতে এগিয়ে আসার মহড়া রাজপথে-কাজপথে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, অনলাইন প্রেস ইউনিটি