দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় সাদা সোনা হিসেবে পরিচিত চিংড়ি ব্যাপক হারে উৎপাদন হয়। গত তিন দশকে ওসব এলাকায় বেড়েছে ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষ। কিন্তু গত এক বছরের ৩টি ঘূর্ণিঝড় ও কভিড-১৯-এর যুগপৎ প্রভাবে এখন মহাবিপর্যয়ের মুখে খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি উৎপাদন। রফতানি বন্ধ থাকায় এ অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদনে মারাত্মক ভাটা পড়েছে। ফলে মহাসঙ্কটে পড়েছে বর্তমানে চিংড়ি উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সেখানকার ২২ লাখ পরিবারের জীবন-জীবিকা। চিংড়ি উৎপাদনকারী এবং মৎস্য অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, খুলনা বিভাগের তিন জেলায় প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজারটি চিংড়ির ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে গত অর্থবছরে প্রায় ৯০ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছিল। চলতি মৌসুমে তা এক লাখ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তুঘূর্ণিঝড় ও মহামারী তাতে বাদ সেধেছে। ফলে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশ চিংড়ি উৎপাদন করতে পারা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় আম্পানে তলিয়ে যাওয়া ঘেরগুলোকে দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব হলে কিছুটা হলেও উৎপাদন সম্ভব হতে পারে। কিন্তু রফতানির বাজার বন্ধ থাকায় তা বিক্রি করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় বাজার একমাত্র ভরসা। তবে সেখানে ভালো দাম না পাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এমন অবস্থায় চিংড়ি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িত বিপুল জনগোষ্ঠি পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১৯ সালের মে মাসে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ফনী হানা দেয়। তারপর চিংড়ি উৎপাদনের মৌসুম শুরুর কয়েক মাস পেরোতে না পেরোতে গত অক্টোবরে আবহাওয়াজনিত কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ঘেরগুলোর অসংখ্য গলদা চিংড়ি মারা যায়। আবার ১০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে শিল্পটির সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। তারপরও ওই অঞ্চলের খামারি ও ব্যবসায়ীরা হাল ছাড়েনি। বরং তারা নতুন বাজার খুঁজে উৎপাদন শুরুতে মনোযোগী হয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই চলতি বছরের শুরুতে কভিড-১৯-এর কারণে চিংড়ি রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ব্যাপক লোকসানে পড়ে চাষী ও ব্যবসায়ীরা। সেখান থেকেও ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল। কিন্তু চলতি মাসের ১৯-২০ তারিখে ঘূর্ণিঝড় আম্পানসৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ির ঘেরগুলোর প্রায় সবই ভেসে গেছে।
সূত্র আরো জানায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসে চিংড়ি ঘেরগুলো ভেসে গিয়েছে। তার আগে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে চিংড়ি শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে পানিতে প্লাবিত হয়েছে খুলনা অঞ্চলের ১ হাজার ৫৯২ দশমিক ১২ হেক্টর জমিতে গড়ে ওঠা ৮ হাজার ৯২৮টি পুকুর ও দীঘি। তার মধ্যে কুঁচিয়া ও কাঁকড়া চাষে ব্যবহৃত পুকুর রয়েছে ৬১৩টি। তাছাড়া ২৪ হাজার ৭৬২ দশমিক ৩৫ হেক্টর জমির ২২ হাজার ২৪৭টি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুলনা বিভাগের চিংড়ি উৎপাদনকারী জেলাগুলোয় সব মিলিয়ে সরাসরি ক্ষতির শিকার হয়েছে ৩ হাজার ৬৩৫ দশমিক ৮৯ টন চিংড়ি। তাছাড়া ২৯ কোটি ৩৮ লাখ পিস চিংড়ির পোনা (পিএল) এবং ৪২ দশমিক ৯৫ টন কাঁকড়া ও কুঁচিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ৩ হাজার ১৬০ টন মাছ ও ১ কোটি ৭৭ লাখ ৮২ হাজার পিস মাছের পোনা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পাইকগাছা উপজেলাভিত্তিক ঘের ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া রিপন জানান, এক বছর ধরে দুর্যোগ পিছু ছাড়ছে না। তার মধ্যে করোনা আর আম্পানের যুগপৎ আঘাতে সব স্বপ্নই ধূলিসাৎ হয়েছে। করোনার আগে রফতানি ঠিক ছিল। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে তা আর নেই। স্থানীয় বাজারই ভরসা। তার মধ্যে মাদার সংকটের কারণে চিংড়ি উৎপাদন পোনাস্বল্পতায় ভুগছিল। এখন আম্পানের আঘাতে লোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে চাষীর সব স্বপ্নই শেষ। আগে হ্যাচারিতে আসা একেকটি মাদারে ৭-৮ লাখ পোনা মিলতো। কিন্তু এপ্রিলে এসে দেখা গেল একেকটি মাদারে ৩-৪ লাখের বেশি পোনা মিলছে না। বাগদা চাষীরা সাধারণত মার্চ-এপ্রিলে আড়ত ও রফতানিকারকদের কাছে চিংড়ি বিক্রি করে থাকে। কিন্তু নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে আড়তগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চিংড়িও থেকে অবিক্রীত থেকে গেছে। এর মধ্যে ঘেরগুলোয় সংরক্ষিত চিংড়ির সঙ্গে উৎপাদিত কিছু কম দামে হলেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা সম্ভব ছিল। কিন্তু আম্পানে জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে আসা লোনা পানির প্রভাবে সেগুলোও মরে গেছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে খুলনা বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নারায়ণ চন্দ্র ম-ল জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে খুলনা বিভাগের ৬টি জেলার ১৯৭টি ইউনিয়নের শুধু মৎস্য খাতেই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে ৬৪ কোটি টাকার মাছ, ১৮৮ কোটি টাকার চিংড়ি, ৩ কোটি টাকার মাছের পোনা, ১৬ কোটি টাকার চিংড়ি পোনা (পিএল), প্রায় ২ কোটি টাকার কুঁচিয়া ও কাঁকড়া এবং ১০ কোটি ৯৪ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলাভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানে দেখা যায় মোট ক্ষতি ২৮৪ কোটি টাকার মধ্যে খুলনায় ৯৭ কোটি টাকা, বাগেরহাটে ৬ কোটি, সাতক্ষীরায় ১৭৬ কোটি, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গায় আড়াই কোটি টাকা করে এবং মাগুরায় ৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।