করোনা পরিস্থিতিতে আটকে আছে সারা বিশ্বের জীবনচলা। শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির বিস্তার বেড়ে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেছেন, ‘করোনার নতুন ও বিপজ্জনক ধাপে আমরা।’ একদিনেই করোনায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দেড় লাখের বেশি শনাক্ত হয়েছে, যা একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের একটি রেকর্ড। আমরা বিপজ্জনক দশায় আছি। ভাইরাসের বিস্তারকে থামাতে লকডাউন ব্যবস্থা এখনো প্রয়োজন।’ এমন একটা পরিস্থিতি আসবে বিশ্বজুড়ে তা যেমন বাংলাদেশ সরকারের জানার কোন সুযোগ ছিলো না; সুযোগ ছিলো বিশ্বব্যাপী কোন দেশের সরকারেরও। তবু বাংলাদেশের মত মধ্যম আয়ের দেশ দাবীকারী রাজনৈতিক অস্থিরতার এই ভূখন্ড ব্যতিত কোন দেশে সরকার জনগনকে করোনা পরিস্থিতিতে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়নি। বরং বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল মধ্যম আয়ের দেশ-উন্নয়নশীল দেশ সাধারণ মানুষকে খাবার নিশ্চিত করেছে, জীবন চলার সবরকম সুযোগ দিয়ে অস্থায়ি লকডাউনের মাধ্যমে মহামারিকে করেছে প্রতিরোধ। অধিকাংশ দেশেই এখন নির্মম মহামারি নিয়ন্ত্রণে।
অস্থির, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা এই বাংলাদেশ ব্যতিত সকল দেশেই সাধারণ মানুষকে খাদ্য দিয়ে ঘরে রাখার মধ্য দিয়ে অন্তত করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বিশ্বব্যাপী তাই করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বার্থক কোন কোন দেশে স্বাভাবিক অবস্থাও বিরাজ করছে। স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হয়েছে, অফিস-আদালতও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কেবল বাংলাদেশ সহ কয়েকটি দেশে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে নেমে আসছে যন্ত্রণার গজব। বিশ্বব্যাপী এক জরিপের পর জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৮৬ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি করোনায় সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এতে মারা গেছে চার লাখ ৫৯ হাজার ৪৩৭ জন। বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ শনাক্তের শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে ২২ লাখ ১৯ হাজার ৯৭৬ জন শনাক্ত হয়েছেন। এরপর রয়েছে ব্রাজিল। সেখানে ১০ লাখ ৩২ হাজার ৯১৩ জন শনাক্ত হয়েছেন। জনস হপকিনসের তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে সংক্রমিত রোগী শনাক্তের দিক থেকে বাংলাদেশ ১৭ নম্বরে। আমাদের দেশে মোট শনাক্ত হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৩৫ জন। সেই সাথে বলে রাখি- সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শনাক্ত হওয়া রোগীদের অর্ধেকের বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। এরপর উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় দক্ষিণ এশিয়ার রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
তবে বরাবরের মত অবিরত অঅমি বলতে চাই যে, অসচেতন-নিরন্ন মানুষদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস এখন দ্রুত ছড়াচ্ছে, এটা এখনো মারাত্মক এবং অধিকাংশ মানুষ এখনো সংক্রমণ সংবেদনশীল। অনেক লোক বাড়িতে থাকার কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, যা সহজে বোধগম্য এবং অনেক দেশ লকডাউন তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তবে যেহেতু এটি এখনো দ্রুত ছড়াচ্ছে, তাই সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার মতো বিষয়গুলো এখনো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ, চাকুরিজীবীর চাকুরি নেই। আর তাই তাদের রুটি-রুজি-জীবন-জীবীকার জন্যই তারা বেরুচ্ছে ঘর থেকে, করোনা ছড়াচ্ছে দ্রুত। এভাবে চলতে থাকলে শরণার্থীদের ওপর বেশি প্রভাব পড়বে। তারা বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বাস করছেন। আমাদের কোভিড-১৯ শনাক্ত, প্রতিরোধ ও সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে খাবার-জীবন নির্বাহের জন্য আর্থিক সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
মানুষ-মানুষের পাশে দাঁড়ালে শিগগিরই বিশ্ব একটি ভ্যাকসিন পাবে, যা মহামারির অবসান ঘটাবে। ভ্যাকসিনের প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফল উৎসাহব্যঞ্জক। যদিও আমেরিকা সংক্রমণের নিশ্চিত সংখ্যা ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। সেখানে প্রাণহানির সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। করোনাভাইরাস ছড়ানোর মূলকেন্দ্র হয়ে ওঠা নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি, যেখানে তাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে, সেখানে ২০টি অঙ্গরাজ্যে সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। আর তারই প্রভাবে বিশ্বব্যাপী পড়ছে অর্থনৈতিক মন্দার ঝাপটা। এই ঝাপটায় বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকেই নিম্ন-আয়ের বহু মানুষ হয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। ক্রমে ক্রমে বেকার হচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তদেরও অনেকে। করোনা মহামারির মুখে দেশে বেকার হয়ে পড়া নিম্ন-আয়ের অনেক মানুষকেই বর্তমানে পথে পথে সাহায্য চাইতে বা ভিক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে। কেবলমাত্র একবেলার খাবার জোগাড় করার জন্যও রাস্তার পাশে বসে আছেন অনেক অভাবী আর দুস্থ মানুষ। শিক্ষকতা পেশায় থাকলেও নন এমপিও বেসরকারী স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষকগণ এখন নিজেদের পেশা বদলে মৌসুমী ফলের ব্যবসায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে স্যানিটাইজার-মাস্ক বিক্রির পেশা।
মধ্যবিত্ত-নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তাদের সাথে সাথে তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও কাজের খোঁজে পথে নেমে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ব্রাশ-মাস্ক নিয়ে নেমে যাচ্ছেন ফুটপাতে। লজ্জা-শরম নিয়ে ভাবছেন না কেউ; ভাবছেন বাড়ি ভাড়া দিতে হবে, অন্তত এক বেলার খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক; শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে যখন-তখন; আর তাই ঢাকায় থাকার কথা ভুলে গিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কোন মতে কচুঘেচু খেয়ে দিনযাপন করছেন নিন্মবিত্ত মানুষেরা।
‘করোনা শুরু হওয়ার পর থাইকা আমি আর বাসাবাড়িতে কাজ করতে পারতেছি না। কাজ করতে গেলে বাসাবাড়ির অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ানরা ঢুকতে দেয় না। অহন একবেলা এক মুঠা খাওয়ার জন্য হাত পাইতা রাস্তার ধারে বইসা আছি। যে যা পারে, তাই দেয়, তাই দিয়াই কোনোমতে খাইয়া দিন পার করতাছি। করোনার কারণে আমারে এহন পথে পথে ভিক্ষা করতে হইতাছে।’ বাসায় কাজ করতেন এক সময় এখন নির্মম মহামারি করোনায় সরকারের কোন সহায়তা-ত্রাণ না পেয়ে অবশেষে ভিক্ষাকে বেছে নেয়া একজন নি¤œমধ্যবিত্তের উপরোক্ত বক্তব্যর মত সারাদেশে শুরু হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি। তাতে কি যায় আসে সরকারের!
আমার রাজনীতি-কাজনীতির সূত্রতায় দেখা- শাহবাগ এলাকার একটি সিএনজি পাম্পের সামনে সড়ক আইল্যান্ডের ওপর বসে ছিলেন জরিনা নামের এক নারী। চলাচলের সময় গাড়ি থামিয়ে কেউ কেউ তাকে টাকা বা খাবার দেন। সেই সাহায্য নিয়েই জরিনা পরিবারের মানুষদের দিচ্ছেন। তাঁর হাতে ত্রাণ উপহারের একটা প্যাকেট তুলে দিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- আপনার মত করে সরকারের বড় বড় মন্ত্রী-এমপি আর ব্যবসায়ীরা ক্যান যে আগাইয়া আসে না! আইলে কত্ত ভালেঅ হইতো! দুই-তিন মাস আগে যহন রাস্তার কাজ হইতো, লেবারির কাজ করতাম। এর লগে রাইতে ভাঙাড়ি আর কাগজ টুকাইতাম। করোনার লাইগা সড়কের কাম বন্ধ, ভাঙাড়ি-টুকানির কামও করতে পারিতাছি না। জামাই আর মাইয়া-পোলা লইয়া ছয়জনের সংসার আমার। যে যেমনে পারি, মাইনষের কাছে সাহায্য চাইয়া, ভিক্ষা করে আইনা খাইয়া-পইরা দিন পার করতাছি।’
পাশে ছিলেন নূরজাহান, দৌড়ে আসেন। বলেন- ভাই আমারেও একটা বস্তা দেন না। মাইয়ার জামাইর বাসায় থাকতাম আর রাস্তায় কাগজ টোকাইতাম। করোনায় সেই কাম বন্ধ। তিন মাস ধইরা প্রত্যেক দিন মাইয়ার জামাইর লগে থাকা-খাওয়া নিয়া ঝগড়া হয়। বাসায় খাবারও দেয় না। দুই মাস ধইরা পথে পথে ঘুরি, মাইনষের কাছে সাহায্য চাই। কহনো পাই, কহনো পাই না। লগে টাকা না থাকলে, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার চাইয়া খাই। রইববার ১০০ টাকা পাইছিলাম। আইজ আর কেউ দিবার পারে না, মাইনশেই কোন তোন দিবো?’
ত্রাণ উপহারের প্যাকেটটা কাঁধে তুলে নিয়ে বললেন- এত ভারি ক্যান স্যার? কয় কেজী?
বললাম- মাত্র ১০-১২ কেজী হবে।
বিনয়ের একটা হাসি দিয়ে তিনি পা বাড়ালেন, আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম এমন অন্তত ৩ শ মানুষের মৃয়মান হাসি; শুনলাম তাদের কথা। তাতে কি যায় আসে সাড়ে ৩ বা হাজার মানুষকে কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে আমরা সহায়তা করলেও ঘরে বসে-ঘুমিয়ে কাটাছে ধনীদের দিন। স্কয়ার- বেক্সিমকোর মত রাঘব বোয়াল টাইপের প্রতিষ্ঠানগুলো লোভ মোহের রাস্তায় না হেঁটে চাইলেই পারতো তাদের পাশে দাঁড়াতে, যাদের দিন নিরন্ন কাটছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সরকার চাইলে পারে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা দেয়ার নিদের্শনা দিতে। তাতে করে প্রায় ৫ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক আছে অফিসিয়ালি; তারা ১০ কোটি টাকা করে দিলে এবং তা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ভোটার তালিকা দেখে সরকাররি চাকুরিজীবী বাদ দিয়ে অভূক্ত মানুষগুলোকে অন্তত নগদ টাকা না হোক চাল-ডাল-তেল ও বাড়ি ভাড়া সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে অন্তত ১ মাস লকডাউন নিশ্চিত করলে সব সমস্যা সমাধান সম্ভব। আর তাতে করে রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বুদ্ধিদীপ্ততা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। বেঁচে থাকবে বিনয় আর ভালোবাসার রাজনীতি-কাজনীতি। তা করবে কিনা জানি না, তবে করলে লাভবান হতো দেশ-মানুষ-সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টা...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি