পুরো অর্থবছর জুড়ে শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই। মূলত রাজনৈতিকসহ বিভিন্নভাবে অনুমোদন নিয়ে চলমান এবং নতুন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয় না। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও ওরকম ১২১টি উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। পুরো অর্থবছরেও ওসব প্রকল্পের কোনো ধরনের অগ্রগতি হয়নি। ওসব প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি প্রকল্প, দেশের ৩টি বিমানবন্দরের উন্নয়ন, রেলের উন্নয়ন, ডিপিডিসি এলাকায় বিদ্যুৎ সিস্টেম নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করার প্রকল্পও রয়েছে। আবার এক হাজার ১৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও শতাধিক প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা একটি টাকাও খরচ করতে পারেনি। ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ৩৪টিরই অর্থ ব্যয় করার সক্ষমতা কম রয়েছে। অথচ অনেক উন্নয়ন প্রকল্প টাকার অভাবে নির্ধারিত মেয়াদে সমাপ্ত করা যায় না। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পুরো অর্থবছর জুড়ে অগ্রগতিহীন ১২১ প্রকল্পের মধ্যে কিছু প্রকল্প ২০১৫, কিছু প্রকল্প ২০১৭ এবং কিছু ২০১৮ সালে শুরু হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রোহিঙ্গা, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে, দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়নের প্রকল্পও রয়েছে। অগ্রগতিহীন প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিপিডিসি এলাকায় বিদ্যুৎ সিস্টেম নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করা, ৫১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ, সম্ভাব্যতা যাচাই, এক হাজার ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২শ’ মেগাওয়াটের আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্লান্ট, ২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ, ২৩ জেলায় ৩ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন, ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন, আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অধিক ছাত্র ভর্তির জন্য বাড়তি সুবিধা উন্নয়ন, ৩ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কাঁচপুর-সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে চার লেন নির্মাণ, এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলের পার্বতীপুর টু কাউনিয়া সেকশনে মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, ৩ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলের খুলনা টু দর্শনা জংশনে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ, ৫ হাজার ৭১০ কোটি টাকা ব্যয়ে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ রেলের ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ, ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আশুগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদীবন্দর স্থাপন, ৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ, ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, ৫৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে শক্তিশালী করা, ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক স্থাপন, ৩৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে শাহজিবাজার ৭০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্টকে ১৫০ কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর, ৫১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০ মেগাওয়াট বাঘাবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ১৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর, ১০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুতের ইভেক্যুয়েশন সুবিধার অবকাঠামো উন্নয়ন, এক হাজার ১৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে কুমিল্লাতে ব্যাক টু ব্যাক স্টেশন নির্মাণ, সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে কাওরান বাজারে আন্ডারগ্রাউন্ড সাবস্টেশন নির্মাণ, প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ডিপিডিসির বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ৬৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিপিডিসি এলাকায় সাড়ে ৮ লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন।
সূত্র জানায়, অর্থবছর জুড়ে অগ্রগতিহীন ঘুমিয়ে থাকা প্রকল্পের মধ্যে আরো রয়েছে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আইসিবি’র বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্প, প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে থিম্পুতে বাংলাদেশ চ্যান্সেরি ভবন নির্মাণ, প্রায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে জামার্নিতে চ্যান্সেরি ভবন ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবন নির্মাণ, প্রায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রুনাইতে বাংলাদেশ চ্যান্সেরি কমপ্লেক্স ও রাষ্ট্রদূতের আবাসিক ভবন নির্মাণ, ৩৪০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে র্যাবের ভোকেশনাল ও কারিগরি দক্ষতা, ১২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটনিং প্রকল্প, ৩৭.৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিজিবির ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ, প্রায় ৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিজিবির বর্ডার এলাকায় ৬০টি বিওপি নির্মাণ, ৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে গোপালগঞ্জে শেখ রাসেল হাইস্কুল ও সূত্রাপুরে শের-ই-বাংলা মহিলা কলেজ উন্নয়ন, ৬৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্বাচিত ৯টি সরকারি কলেজের উন্নয়ন, ১৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫০ বেডের জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হসপিটাল নির্মাণ, ৪৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে রিমোট এলাকায় আইসিটি নেটওয়ার্ক স্থাপন, ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে রমনা পার্ক উন্নয়ন ও লেকের সৌন্দর্যবর্ধন, প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আজিমপুরে সরকারি আবাসিক ভবন নির্মাণ, ৪২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০তলা বিশিষ্ট সচিবালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রামে এক হাজার ১৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ, এক হাজার ৩৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৬টি পরিপূর্ণ স্টেশন নির্মাণ, ৬৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস ডেলিভারি প্রকল্প, ৬৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ফেনী নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ, সোনাগাজী ও মিরসরাই অর্থনৈতিক জোনের লিংক রোড প্রকল্প, ঢাকা উত্তর সিটির জন্য ৪৪২ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কে এলইডি লাইট, সিসিটিভি ক্যামেরা এবং সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন, সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকায় ৩টি হোলসেল বাজার স্থাপন, ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী ওয়াসার সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ৪২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পল্লী জনপদ প্রকল্প, ১১০ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র ব্যারাজের ডিজাইন নির্মাণ, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় ৩৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প।
সূত্র আরো জানায়, আর্থিক অগ্রগতিহীন ১০৬ প্রকল্পের জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এডিপিতে অর্থ বরাদ্দ ছিল এক হাজার ১৬৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। কিন্তু এক বছরে ওসব প্রকল্পের কোনো অর্থই খরচ হয়নি। অগ্রগতি না হওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে, অর্থ ছাড় না হওয়া, দেরিতে অর্থ ছাড় করা, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়া, দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব, দরপত্র রেসপন্সিভ না হওয়া, প্রকল্পের ঋণ না পাওয়া, নামমাত্র বরাদ্দ, মামলাজনিত সমস্যা, সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনে বিলম্ব, দাতা সংস্থার সাথে চুক্তি হতে দেরি ইত্যাদি।
এদিকে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি এবং বারবার সংশোধনের সংস্কৃতির অবসান হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। উন্নয়ন কার্যক্রম বছরের পর বছর চলমান থাকার কারণ সম্পর্কে আইএমইডির পর্যবেক্ষণ হলো, যথাযথ সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ ও ব্যয় প্রাক্কলন করা হচ্ছে। অথচ বিনিয়োগ প্রকল্পের ব্যয় ২৫ কোটি টাকার বেশি হলেই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সার্বিক পরিকল্পনা অনুসরণ করা হয় না। পাশাপাশি বেজলাইন ডাটা সংরক্ষণ ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বৈদেশিক সহায়তাপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার নানা রকম শর্ত অনেকসময় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি করছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের সাথে বাস্তবায়নকারী সংস্থার সমন্বয়হীনতাও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দক্ষ জনবল না থাকায় প্রকল্প সমাপ্তির পরে প্রায়ই বিদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সেবা ক্রয় চুক্তি করতে হয়। তাতে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে।
অন্যদিকে এ ব্যাপারে আইএমইডির মহাপরিচালক ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা কমিটির সভাপতি এস এম হামিদুল হকের মন্তব্য হলো, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিসহ বারবার সংশোধনের প্রবণতা রয়েছে। কোনো একটি প্রকল্প নির্ধারিত মেয়াদে বাস্তবায়ন করতে না পারলে ওই প্রকল্পের সুফল প্রাপ্তিতে যেমন বিলম্ব ঘটে, একইভাবে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়ে যায়। উন্নয়নকে কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছাতে হলে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি ও বারবার সংশোধনের সংস্কৃতির অবসান হওয়া প্রয়োজন। যেসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিঘিœত হয়, তা চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সেক্ষত্রে ১৫টি সমস্যা চিহ্নিত করা গেছে।