দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি নতুন নয়। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের মোট গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংকে, দেশীয় মুদ্রায় যার মূল্যমান ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ সামান্য কমলেও আশঙ্কার বিষয় হল, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান এবং টাকা পাচারের ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। টাকা পাচারের অন্যতম মাধ্যমগুলো হচ্ছে ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজার ও বৈদেশিক বাণিজ্য। তবে এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানির নামে তা বিদেশে পাচার করে দেয়ার ঘটনাই বেশি ঘটছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমাকৃত টাকার অধিকাংশই দুর্নীতির মাধ্যমে আহরিত। এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। অর্থ পাচার রোধ করতে হলে প্রথমত দুর্নীতি হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। একইসঙ্গে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি। সর্বোপরি অর্থ পাচারকারীদের শনাক্ত করে নিতে হবে আইনানুগ ব্যবস্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে মূলত চার প্রক্রিয়ায়। এগুলো হল- বিদেশি পণ্যের আমদানিমূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিমূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির প্রতিবেদনসহ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘আইসিআইজে’ প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসেও। অর্থনীতি সমিতির এক সেমিনারে উপস্থাপিত ‘বাংলাদেশের আয় ও ধন বৈষম্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য দিয়ে বলা হয়েছিল, প্রতি বছর ব্যাংক খাত থেকে ঋণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে এবং লুট হওয়া অর্থের সিংহভাগই পাচার হচ্ছে বিদেশে। এছাড়া বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক ‘ত্বরিত মূল্যায়ন জরিপে’ অংশ নেয়া ব্যবসায়ীদের ৬১ শতাংশ টাকা পাচার বাড়ছে এ অভিমত ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে (আর্থিক খাত) বিশৃঙ্খলা নিয়ে তারা চিন্তিত এবং এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। বস্তুত ব্যাংক খাতে দুর্নীতি রোধে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত শক্তিশালী ও কঠোর মনিটরিং পদ্ধতি গড়ে তোলা জরুরি।
বিদেশে অর্থ পাচার একটি গুরুতর অপরাধ। এজন্য শাস্তির বিধান রেখে আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। তারপরও টাকা পাচারের ঘটনা কেন বন্ধ হচ্ছে না, এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অভিযোগ রয়েছে, টাকা পাচারের বিষয়টি ক্ষমতাসীনরা অবহিত থাকলেও মূলত রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকেই অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। আমরা মনে করি, টাকা পাচারের বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার অবকাশ নেই। অর্থ পাচারকারীরা যাতে কোনোভাবেই পার না পায়, সরকারের উচিত তা নিশ্চিত করা। তা না হলে অর্থ পাচার ক্রমাগত বাড়তে থাকবে, যা মোটেই কাম্য নয়।