করোনা প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে নানা পেশার মানুষ জীবিকা নিয়ে বিচিত্র ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এর জের ধরে সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কাও দিন দিন বাড়ছে। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির পর সীমিত পরিসরে সব কিছু খুলে দেয়ার পরও পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হচ্ছে না। বন্ধ থাকায় অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছে না। মার্কেটগুলো খুলে দেয়া হলেও সেখানে ক্রেতাসাধারণের উপস্থিতি নগণ্য। আর সড়কে গণপরিবহন নামলেও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাতে হকাররা পসরা নিয়ে বসলেও ক্রেতা নেই। আবার অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মী ছাঁটাই। এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সামাজিক অসন্তোষের পাশাপাশি নানা ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আপাতদৃষ্টিতে বর্তমানে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকা শান্ত থাকলেও মাঝে মধ্যে দু-একটি এলাকায় বেতন-ভাতার দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় নামছে। তবে রাজধানীর এই শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠার আশঙ্কা রয়েছে। পুলিশ বিভাগের আশঙ্কা, সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে চলমান অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নতুন নতুন অপরাধ। কারণ রাজধানীতে বেসরকারি হাই স্কুল ও কলেজ, কিন্ডারগার্টেন এবং কোচিং সেন্টারে ৩ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। তার মধ্যে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক সংখ্যাই এক লাখের বেশি। বর্তমানে ওসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বন্ধ। আর সরকারের সাধারণ ছুটির পর সড়কে গণপরিবহন নামলেও যাত্রী স্বল্পতায় কোনো কোনো পরিবহনের তেলের খরচই উঠছে না। অথচ রাজধানীতে ২০ লাখের বেশি পরিবহন শ্রমিক রয়েছে। তারা ভীষণ আর্থিক কষ্টে আছে। পাশাপাশি অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মী ছাঁটাই। ফলে হঠাৎ করেই অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ছে। তাছাড়া রাজধানীজুড়ে কয়েক লাখ হকার ফুটপাতে ব্যবসা করে। বর্তমানে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসলেও সেভাবে ক্রেতা না পাওয়ায় তারা মহাসংকটে রয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনার সময়ে দেশে অপরাধ অনেক কমেছিল। কিন্তু গত চার মাস অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক পরিবহন শ্রমিক দিনে গাড়িতে কাজ করে রাতে ছিনতাই করছে। এ শ্রেণিটাকে নিয়ে ভয় রয়েছে। ইতিমধ্যে এমন অনেক আসামি ধরা পড়েছে, যারা দিনে গাড়ির হেলপারি করে আর রাতে করে ছিনতাই। তাছাড়া আর দু-তিন মাস পর মধ্যবিত্তের জমানো টাকা ফুরিয়ে যাবে। বেসরকারি চাকরি যারা করেন, তাদের অনেকের চাকরি থাকবে না। সেক্ষেত্রে শুধু গার্মেন্টকর্মী নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও রাস্তায় নেমে পড়তে পারে। বাড়িভাড়া অর্ধেক করা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল কমানোর আন্দোলন হতে পারে। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের চুরি-ছিনতাই-ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়াসহ নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, করোনায় অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধ, প্রতারণা বাড়তে পারে। সহিংসতার দিকে যেতে পারে সম্পত্তির ঘটনা। ঈদুল আজহার আগেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রকট হতে পারে। সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অপরাধ দমনের বিষয়ে এখনই ভাবতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই বন্ধসহ সরকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে না পারলে অবস্থার অবনতি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। করোনাকালে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে না পারলে আসছে কোরবানির ঈদের আগেই পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে সামাজিক অসন্তোষজনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় কর্মপন্থা ঠিক করতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বৈঠক করেছেন। ডিএমপি কমিশনার জানান, সামাজিক অপরাধ বাড়তে পারে। স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ, যৌতুকের জন্য চাপ, পারিবারিক অপরাধ, চুরি-ছিনতাই এসব বাড়তে পারে। তবে পুলিশ বিভাগ নজরদারি বাড়িয়েছে। অপরাধ রোধে প্যাট্রল বাড়ানো, আসামি ধরা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি সব থানার ওসিদের নিয়ে মিটিং করা হয়েছে। সেখানে অপরাধ বাড়তে পারে- এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অপরাধ রোধে যে যে কৌশল রয়েছে সেসব প্রয়োগ করা হবে। আর আয় কমে গেলে সব মানুষই কিন্তু অপরাধ করে না। যারা অপরাধ করবে তাদের আইনের আওতায় আনতে মাঠপর্যায়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।