দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সরকার ও মিল মালিকরা। সরকার যে কোনো মূল্যে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছে। বিপরীতে মিল মালিকরা করোনা ও বন্যার সুযোগে অতি মুনাফা তুলে নিতে বেপরোয়া। এমন পরিস্থিতিতে মিল মালিকরা সরকারকে চুক্তিমূল্যে চাল সরবরাহ করতে চাচ্ছে না। সরকার প্রতি কেজি চালের সংগ্রহমূল্য ৩৬ টাকা ঠিক করে মিলারদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। কিন্তু মিলাররা নানা অজুহাতে কেজিতে তিন থেকে চার টাকা বাড়তি দাম দাবি করছে। এমন অবস্থায় চুক্তি অনুযায়ী মিলগুলো চাল না দিলে সরকার শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিংও জোরদার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা রোধে চালের মিল, আড়ত ও বাজারে অভিযান জোরদার করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটি অতিসম্প্রতি দিনাজপুর ও খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার চালের মিলে অভিযান পরিচালনা করে দাম তদারকি করে। খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং চালকল সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাজারে সরবরাহ করা চালের দাম সম্প্রতি মিল মালিকরা বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মিলগুলো বাড়তি দামে বাজারে চাল সরবরাহ করছে। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের খুচরা মূল্য ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এক মাস আগেও যা ৩৬ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর বাজারে বাড়তি দামে বিক্রির সুযোগ থাকায় মিলগুলো সরকারকে চাল দিচ্ছে না। বরং তারা বেশি লাভ তুলে নিচ্ছে খোলাবাজারে চাল বিক্রি করে। গত ৩০ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন বোরো ধান-চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। তার মধ্যে ৬ লাখ টন ধান। তারপর ওই কমিটি আরো ২ লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ৮ লাখ টন ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার কথা রয়েছে। ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয়ে তা আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। কিন্তু এখনো সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত ধান-চাল না আসায় সরকারের বোরো সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। কারণ চুক্তি অনুযায়ী চালকল মালিকরা (মিলার) সরকারকে চাল দিচ্ছে না। বরং অনেক মিলার অবৈধ মজুদ গড়ে তুলে বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চালকল মালিকরা সরকারিভাবে চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর দাবি তুলেছে। তবে মিল মালিকদের দাবি নাকচ করে দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চুক্তি অনুযায়ী মিল মালিকরা সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ না করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। একইভাবে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার চাল আমদানি করবে।
সূত্র জানায়, কোনভাবেই চাল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তারা নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়েই চলেছে। কোন কারণ না থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দাম বাড়ছে। চালের বাজার বিষয়ে সরকার একের পর এক কঠোর বার্তা দিলেও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা তা আমলেই নিচ্ছে না। সরকার যতই কঠোর হচ্ছে, ততোই কৌশল বদলাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এবার সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে চালের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে তারা। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ত্রাণ বিতরণে সরকার মোটা চাল ব্যবহার করছে। তাতে চাহিদা বেড়েছে। তাই মোটা চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও চালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। কোথাও আবার দাম কমার নজিরও রয়েছে। তবে সার্বিকভাবে এটা স্পষ্ট যে, চালের দাম বাড়ানো অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি মাত্র। কারণ এবার বোরোর বাম্পার ফলন বন্যার আগে কৃষকরা ঘরে তুলেছে। ফলে দেশে পর্যাপ্ত ধান ও চাল রয়েছে। তাছাড়া এবার সরকারি গুদামে এখনো ৯ লাখ পাঁচ হাজার টন চাল মজুদ রয়েছে। পাশাপাশি বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। থাইল্যান্ড, ভারত ও ভিয়েতনামে প্রতি টন চালের মূল্য ৩৭৫ ডলার থেকে ৪৮৫ ডলার রয়েছে। ওই হিসাবে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৩২ টাকা থেকে ৪১ টাকা।
সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েই চলেছে। কয়েক দফায় দাম বেড়ে বর্তমানে ৩২ টাকার গুটি (মোটা) চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকা পর্যন্ত। বেড়েছে স্বর্ণা, পাইজামসহ অন্য মোটা চালের দামও। আর চালের দাম নিয়ে খোদ ব্যবসায়ীদের মধ্যেই রয়েছে ভিন্নমত। বড় ব্যবসায়ীরা বলছে, সরকারিভাবে মোটা চাল কেনায় মোটা চালের কিছুটা সঙ্কট রয়েছে। তবে তারপরও বাজারে পর্যাপ্ত চালের মজুদ থাকায় দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। তবে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে শুরু হওয়া বন্যায় এরপর কী হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তাছাড়া সরকারিভাবে এখন চাল সংগ্রহ চলায় মোটা চালের কিছুটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। তবে বাজারে যে চাল মজুদ আছে সে তুলনায় ক্রেতা নেই। ফলে যারা দাম বাড়াচ্ছে তারা কেন চালের দাম বাড়াচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।
এদিকে চালকল মালিকদের মতে, মিলাররা যে দামে ধান কিনছে তাতে নির্ধারিত দামে সরকারকে চাল দেয়া সম্ভব নয়। কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা ঘাটতি রয়েছে। শুরুতে যারা কম দামে ধান কিনেছে তারা সরকারকে চাল সরবরাহ করেছে। এখন বেশি দামে কেনা ধান কম দামে দেয়া সম্ভব নয়। মিলাররা নির্ধারিত দামে সরকারের সাথে চাল সংগ্রহের চুক্তি করতে চায়নি। কিন্তু তখন কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছিল দাম বাড়লে ব্যবস্থা নেবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশীদ জানান, সরকার ধানের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে চালের দাম নির্ধারণ করেনি। ধানের দাম ২৬ টাকা হলে চালের দাম ৪০ টাকা হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে ৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের চাল আমদানির প্রয়োজন নেই। মোটা ধানের সরবরাহ কম। তার পরেও মিলাররা ৬০ শতাংশ চাল সরবরাহ করলেই তা দিয়ে আগামী মৌসুম পর্যন্ত চাহিদা মিটবে। তাতে বড় ধরনের সমস্যা হবে না। কারণ দেশে পর্যাপ্ত ধান রয়েছে।
অন্যদিকে চাল আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানে মোট ৫৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। তার মধ্যে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবেও চাল আমদানি উন্মুক্ত করে দিতে চাচ্ছে। কারণ সঙ্কট না থাকা সত্ত্বেও কোন অবস্থায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এজন্যই প্রয়োজনে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, বাজার অস্থিতিশীল করা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী চাল আমদানি করা হবে। কৃষকদের স্বার্থ বজায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে ২০১৭ সালের মতো ঢালাওভাবে চাল আমদানির সুযোগ দেয়া হবে না। এবার মৌসুমে পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন হয়েছে। আর মিলাররা বাড়তি দাম দাবি করলেই সরকার তা দেবে না। গত বছর একই দামে তারা ধান ও চাল সরবরাহ করেছে। তখন কৃষক ঠকলেও তারা কেজিতে ৮ টাকা লাভ করেছে। এবার কম লাভ করে তাদের চাল সরবরাহ করা উচিত। কৃষকদের উৎসাহিত করতে ধানের ভালো দাম দিতে চায় সরকার। আবার ভোক্তাদেরও যৌক্তিক দামে চাল কেনার সুযোগ দেয়া হবে।