দেশের আন্তঃজেলা রুটে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা বাস সেবা চালু করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। অজুহাত হিসেবে ১৭ বছর আগের একটি চুক্তির কথা তুলে ধরা হচ্ছে। মূলত বিআরটিসি নতুন বাস নামালে আয় কমে যেতে পারে এমন আশঙ্কাতেই মালিক-শ্রমিকরা বারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এমনকি প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিয়েও অনেক এলাকায় সরকারি বাস চালানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। বরং বেসরকারি পরিবহন মালিক শ্রমিকদের চাপে পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সেবা সংস্থাটি বাস চালু করে লাভবান হতে পারছে না। ফলে বিআরটিসির অনেক দ্বিতল বাস এখন অলস বসে রয়েছে। বিআরটিসি এবং বেসরকারি পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বেসরকারি পরিবহন থেকে তুলনামূলকভাবে সরকারি বাসের ভাড়া কম হওয়ায় আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসি বাসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়ছে। ১৭ বছর আগের এক চুক্তির সুযোগ নিয়ে পরিবহন মালিকরা বিআরটিসিকে বারবার চাপে ফেলছে। আর কৌশল হিসেবে শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বিগত ২০০৩ সালে তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকারে যোগাযোগমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসি দোতলা বাস নামানো হবে না। অথচ রাষ্ট্রীয় সংস্থা সড়ক পরিবহন করপোরেশনের দেশের যে কোন জায়গায় বাস চালুর এষতিয়ার রয়েছে। কিন্তু যখনই বিআরটিসি রুটে নতুন বাস নামানোর উদ্যোগ নেয়, তখন বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তাতে বাধা দেয়। বর্তমানে বিআরটিসির নতুন ৬শ’ বাস রয়েছে। এ অবস্থায় বেশ কিছু রুট চালুর পরিকল্পনা নেয়া হলে বেসরকারি পরিবহন খাতের সাথে সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। যদিও গত বছর জুনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করপোরেশনের করা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) বিআরটিসির বাস চলাচলের ক্ষেত্রে বেসরকারি পরিবহন মালিকদের অযাচিত বাধাকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
সূত্র জানায়, বিআরটিসি’র ৬শ’ নতুন বাসসহ বর্তমানে মোট বাসের সংখ্যা ১ হাজার ৮৭৩টি। তার মধ্যে ৩৮৪টি রুট ১ হাজার ৩৫৭টি বাস চলছে। আর ২৫৯টি বাস একেবারেই চলাচলের অনুপযোগী এবং ২২৪টি বাস নষ্ট হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে রয়েছে। তবে সেগুলো মেরামত করে রাস্তায় নামানো সম্ভব। আর প্রয়োজনীয় নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হলে ৩৩টি নতুন বাস রাস্তায় নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ পরিবহন সেবা বাড়াতে সরকার বিআরটিসির জন্য ভারতীয় নির্মাতাদের কাছ থেকে ৬শ’ বাস ও ৫শ’ ট্রাক কেনে। দুটি চুক্তির আওতায় প্রায় ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা যানবাহনগুলো গত বছর বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে পৌঁছে। তার মধ্যে রয়েছে ৩শ’ ডাবল ডেকার, ১শ’ নন-এসি বাস, ১শ’ সিটি বাস (এসি), ১শ’ আন্তঃনগর বাস (এসি), ৩৫০টি ১৬ দশমিক ২ টন ওজন পরিবহনের সক্ষম ট্রাক এবং ১৫০টি ১০ দশমিক ২ টনি ট্রাক।
সূত্র আরো জানায়, পরিকল্পনামাফিক বিআরটিসি নতুন রুটগুলোতে বাস চালুর উদ্যোগ নিলে নেত্রকোনা, দিনাজপুর, বগুড়া, বরিশাল, সুনামগঞ্জ ও রংপুরে স্থানীয় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা তাতে বাধা দেয়। স্থানীয় পরিবহন শ্রমিকদের আপত্তির মুখে গত ফেব্রুয়ারিতে রংপুর শহর এবং এর আশপাশের এলাকায় বিআরটিসি দোতলা বাস চলাচল স্থগিত করে দেয়া হয়। তাতে অসংখ্য যাত্রী ভোগান্তিতে পড়ে। জাতীয় সংসদের স্পীকার ও রংপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন শারমিন চৌধুরী গত বছরের মে মাসে রংপুরে দোতলা বাস সার্ভিসের উদ্বোধন করেছিলেন। ৮টি দোতলা বাস চালুর পর থেকেই বারবার বাধার মুখে পড়ে।
এদিকে বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মতে, চুক্তি অনুযায়ী ডিপোর পরিবর্তে বিআরটিসি টার্মিনাল থেকে বাস পরিচালনা করতে চাইলে ট্রিপ সংখ্যা ও চলাচলের সময় নির্ধারণে স্থানীয় বেসরকারি পরিবহন সংস্থার সঙ্গে আলাপ করতে হবে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বিআরটিসি তা মানে না। বরং অনির্ধারিত স্থান থেকে বাস পরিচালনার মাধ্যমে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ চুক্তি লঙ্ঘন করছে। এ কারণে স্থানীয় শ্রমিক ও মালিকরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বর্তমানে বিআরটিসির ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় মোট ২১টি বাস ডিপো এবং দুটি ট্রাক ডিপো আছে। এক নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকা থেকে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল রুটে বিআরটিসির বাস কল্যাণপুর ডিপো থেকে পরিচালিত হবে। আর মতিঝিল ডিপো থেকে পূর্বাঞ্চলে বাস সার্ভিস পরিচালিত হবে। গত বছর ডিসেম্বরে বিআরটিসি ময়মনসিংহ- নেত্রকোনা রুটে ৫টি দোতলা বাস সার্ভিস চালু করলে বেসরকারি পরিবহনের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে ওই দুই জেলাতেই ধর্মঘট ডাকে বেসরকারী পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলায় বিআরটিসি’র একতলা বাস চলতেও বাধা দেন তারা। শেষ পর্যন্ত আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসি দোতলা বাস চলাচল স্থগিত করা হয়। জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এক পর্যায় মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতার পর একটি বাস চলার অনুমতি দেয়া হলেও নানা কৌশলে তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, ২০০৩ সালের চুক্তি কার্যকর থাকায় স্থানীয় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা বিআরটিসি’র উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন। তাছাড়া মহাসড়কে নসিমন, করিমনের মতো অবৈধ যানবাহন চলায় বেসরকারি পরিবহন শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। নতুন করে আবার বিআরটিসি বাস নামায় তারা আরো উদ্বিগ্ন হয়ে বিআরটিসি বাস চলাচলে বাধা দিচ্ছে। তবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিসির চেয়ারম্যান এহসান-ই-এলাহী জানান, দোতলা বাসের ক্ষেত্রেই বেশি বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়। চুক্তিটি তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী স্বাক্ষরিত হওয়ায় বিআরটিসি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।