করোনা প্রাদুর্ভাবে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো। অস্তিত্বের হুমকির মুখে রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ মেডিকেল কলেজ চিকিৎসক, শিক্ষক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই কয়েক মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। চলমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখনো বেতন-ভাতা নিয়মিত রেখেছে। তবে চলমান সংকট দীর্ঘায়িত হলে তাদের পক্ষেও তা কঠিন হয়ে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চিকিৎসক, শিক্ষক, নার্সসহ জনবল ছাঁটাই করেছে। করোনার এমন কঠিন বাস্তবতায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর অধিকাংশ চিকিৎসক ও শিক্ষকই চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে। তার বাইরে বড়, মাঝারি ও ছোট মিলিয়ে আরো কয়েক হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গত মার্চ মাসের শেষ দিকে সবগুলো মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমও বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। একই সঙ্গে চিকিৎসা কার্যক্রমও আংশিকভাবে শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতাও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান আংশিক বেতন দিয়ে আসছে।
সূত্র জানায়, বিদ্যমান সঙ্কট ভবিষ্যতে আরো বাড়ার আশঙ্কায় ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই শুরু হয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের মতে, মাসের পর মাস ধরে শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি যদি না দেয়, বকেয়া পরিশোধ না করে তাহলে প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে? অন্যান্য বছর এই সময়ে মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো। এবার কবে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় একেকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রতিমাসে ২ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানও তো হিমশিম খাচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, ঢাকা বিভাগের মধ্যে বিগত মার্চ থেকে বেতন বন্ধ রেখেছে শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। মার্কস মেডিকেল এপ্রিল থেকে বেতন দিচ্ছে না। এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল করোনাকালে বেতন দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল, বিক্রমপুরের ভুইয়া মেডিকেল কলেজ ও সিটি মেডিকেল কলেজ পাঁচ মাস ধরে বেতন বন্ধ রেখেছে। ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজও পাঁচ মাস ধরে বেতন বন্ধ রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটি আর বেতন দিতে পারবে না বলে চিকিৎসক, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জানিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের অফিসে যেতেও নিষেধ করা হয়েছে। নর্দান ইন্টারন্যাশনাল ও নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজে আগে থেকেই বেতন অনিয়মিত। করোনার পর প্রতিষ্ঠান দুটি বেতন-ভাতা বন্ধ রেখেছে। শরীয়তপুর মনোয়ারা শিকদার মেডিকেল কলেজ জানিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র উপস্থিত জনবলের বেতন দেয়া হবে। কেউ অনুপস্থিত থাকলে বেতন পাবে না। কেয়ার মেডিকেল কলেজে এপ্রিল ও মে মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। সিলেটের নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজও বেতন দেয়নি।
সূত্র আরো জানায়, ইস্ট ওয়েস্ট পঞ্চাশ শতাংশ বেতন দিলেও আগামীতে বেতন না দেয়ার পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছে কর্তৃপক্ষ। মুন্নু মেডিকেল কলেজ এপ্রিল ও মে মাসে পঞ্চাশ শতাংশ বেতন দিলেও জুন মাসের বেতন এখনও পরিশোধ করেনি। সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ গত তিন মাস ধরে পঞ্চাশ শতাংশ বেতন দিচ্ছে। টাঙ্গাইলের কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ চিকিৎসক ও শিক্ষকদের প্রতি সপ্তাহে একদিন কর্মস্থলে যেতে বলেছে। মাস শেষে তারা চার দিনের বেতন পরিশোধ করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ এপ্রিলে ৬০ শতাংশ বেতন দিয়েছে, মে মাসের বেতন এখনো দেয়নি। শিকদার মেডিকেল কলেজ কর্মস্থলে উপস্থিত থাকলে ৬০ শতাংশ বেতন দেবে আর অনুপস্থিত থাকলে কোনো বেতন দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। ঢাকার মগবাজারের আদ-দ্বীন ও বসুন্ধরার আদ-দ্বীন ৫০ শতাংশ বেতন দিচ্ছে। গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ৬০ শতাংশ করে বেতন দিচ্ছে। বারিন্দ মেডিকেল কলেজ পুরো বেতন দিয়েছে। তবে সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত তারা বেতন পরিশোধে ২ মাসের ব্যবধান রাখেন। অর্থাৎ জুনের প্রথম সপ্তাহে এপ্রিলের বেতন দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দিয়েছে যে জুলাই থেকে তারা ৭৫ শতাংশ বেতন দেবে। নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ মে মাসে প্রি ও প্যারা ক্লিনিক্যাল শিক্ষকদের ৫০ শতাংশ বেতন দিয়েছে। আগামী তিন মাস একই হারে বেতন দেয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রংপুরের প্রাইম মেডিকেল কলেজ এপ্রিলে ৫০ শতাংশ বেতন দিয়েছে। তারপর আর তারা বেতন দেয়নি। সিলেট ওম্যান্স মেডিকেল কলেজ ৫০ শতাংশ বেতন দিয়েছে। খুলনা আদ-দ্বীন, যশোর আদ-দ্বীন ৫০ শতাংশ করে, সিটি মেডিকেল ৬০ শতাংশ এবং গাজী মেডিকেল ৩০ শতাংশ বেতন দিয়েছে। চট্টগ্রামের বিজিসি ট্রাস্ট আগে পুরো বেতন দিলেও মে মাস থেকে ৫০ শতাংশ করে দিচ্ছে। মেরিন সিটি মেডিকেলও মে মাসে ৫০ শতাংশ বেতন দিয়েছে। ময়নামতি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ৬০ শতাংশ বেতন দিচ্ছে। আগামী মাস থেকে প্রতি ক্লাসের জন্য প্রভাষকদের ১ হাজার ৩০০ টাকা করে দেবে বলে জানিয়েছে। সহকারী অধ্যাপক ও অধ্যাপকদেরও প্রতি ক্লাস অনুযায়ী টাকা দেবে। এপ্রিল ও মে মাসে সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ ৫০ শতাংশ বেতন দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি পাওয়া সাপেক্ষে বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে।
এদিকে অনেকের মতে, বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে যে ধরনের মুনাফা করে এসেছে। ওই মুনাফা থেকেই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক-চর্মচারীদের বেতন-ভাতা চালিয়ে নেয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, চলমান পরিস্থিতিতে কারো চাকরিচ্যুতির ঘটনা কাম্য হতে পারে না। আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো দেশের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে শর্ত পূরণ না করেও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গুণগত মানহীন ওসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মানহীন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে বিশেষজ্ঞরা সরকারকে বলে আসসে। কিন্তু তা না করে আরো নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সেগুলো এখন সঙ্কটে পড়েছে। আর সংকট থেকে উত্তরণে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিএমএ মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী জানান, বছরের পর বছর ধরে মুনাফা করে এখন তিন-চার মাসের সংকটেই বেতন বন্ধ করে দেয়া কাম্য হতে পারে না। ছোট্ট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এর পেছনে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরই অবদান রয়েছে। সুতরাং সংকটকালে তাদের বেতন বন্ধ থাকবে, চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটবে তা হতে পারে না। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব আলী নূর জানান, সঙ্কটের বিষয়গুলো নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কিছু চিন্তা-ভাবনা শুরুতে করা হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে করোনা চিকিৎসার বিষয়ে চুক্তি করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে ওসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বহন করা সম্ভব হবে না। পরে তাদের নিজস্ব উদ্যোগে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী চিকিৎসা চালাতে বলা হয়। বিদ্যমান সংকটের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সরকারের সীমিত সম্পদের কথাও বিবেচনায় নিতে হবে।