দেশে শিক্ষা ধ্বংস হচ্ছে একটু একটু করে প্রতিদিন। ৪৯ বছরে রাজনৈতিক কারণে প্রশাসনিক কারণে নির্মম অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ছাত্র-যুব-জনতার জীবনমান। বিশেষ করে এই করোনা পরিস্থিতিতে কেবল সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা, অসহযোগিতার কারণে নিরন্ন মানুষগুলো বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় ব্যবসা হারিয়ে-চাকুরি হারিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন; সাথে সাথে সন্তানের ভবিষ্যতকে মাটি চাপা দিয়ে গেছেন যান্ত্রিক এই শহরের পথে ঘাটে।
একজন নিবেদিত শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মী হিসেবে বলতে পারি- করোনার প্রকোপ আরও দীর্ঘমেয়াদি হলে শিশু শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা আরও বাড়বে। কেননা তাতে নতুন করে শহরের বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে গত সাড়ে ৪ মাসের করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি বা কাজ হারিয়ে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া মাসিক বেতন বা দৈনিক আয় কমে যাওয়ায় আরও অর্ধলক্ষাধিক উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তি ভাড়া বাসা ছেড়ে স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে মেসে উঠেছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-খুলনাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকেও অন্তত চার লাখ নিম্নআয়ের মানুষ উপার্জনহীন হয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। করোনার প্রকোপ শূন্যের কোটায় নামলেও এদের সিংহভাগেরই পরিবার নিয়ে শহরে ফেরার সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় গ্রামে ফিরে যাওয়ার ৫ লাখ পরিবারের শিশু সন্তানদের শিক্ষাজীবন অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষা ধ্বংসই শুধু নয়; ধ্বংস হচ্ছে অর্থনীতিও। এসব পরিবারে শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত- তার সঠিক হিসাব না থাকলেও ন্যূনতম পাঁচ লাখ ছাড়াবে। কেননা কোনো কোনো পরিবারে শিশু শিক্ষার্থী না থাকলেও অনেক পরিবারের দুই বা ততোধিক সন্তান লেখাপড়া করছে। যাদের শিক্ষাজীবনে এরইমধ্যে ছন্দপতন ঘটেছে। এছাড়া করোনার প্রকোপ আরও দীর্ঘমেয়াদি হলে তার সঙ্গে পালস্না দিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা আরও বাড়বে। কেননা, তাতে নতুন করে শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন নির্মম পরিস্থিতিতে সংসারের খরচ সামাল দিতে আরও অনেকে স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। অথচ গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন করে ভর্তির সুযোগ নেই বললেই চলে; করোনাকালে যা একদমই অসম্ভব।
কেননা বেশির ভাগ স্কুলেরই শিক্ষার্থী ভর্তির আসন সংখ্যা সাধারণত বছরের শুরুতেই পূর্ণ থাকে। এছাড়া গ্রামের স্কুলে নিচের ক্লাসে ভর্তি করার সুযোগ পেলেও নতুন করে ভর্তি ফি দেওয়ার সামর্থ না থাকায় অনেকেই সন্তানদের সেখানে ভর্তি করাবেন না। অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থী আগামীতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা দেওয়ার কথা, তারা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। কেননা, ওইসব শিক্ষার্থী ঢাকা কিংবা অন্য কোনো বিভাগীয় ও জেলা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বোর্ড রেজিস্ট্রেশন করেছে, যা স্বল্পসময়ে পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। এর নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের স্কুল পরিবর্তন করাও যথেষ্ট ঝামেলাপূর্ণ। কেননা এ জন্য তাকে শহরে অধ্যায়নরত স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট (টিসি) নিয়ে গ্রামের যে এলাকার স্কুলে ভর্তি হতে ইচ্ছুক সেখানকার সংশ্লিষ্ট বোর্ড পরিবর্তন করতে হবে। পরবর্তীতে ওই বোর্ডের আওতাধীন কোনো স্কুলে ভর্তি হতে হবে। এ পরিস্থিতিতে এসব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।
এমন একটা পরিস্থিতি যখন সারাদেশে শিক্ষাখাতে; তখন উত্তরণের পথ তৈরি না করে ইন্টারনেটের বিল কমানোর প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন আমাদের প্রিয় শিক্ষামন্ত্রী। ডা. দীপু মনি আমার বেশ কয়েকটি বইর মোড়ক উন্মোচনের জন্য বইমেলায় এসেছেন। ব্যক্তিগতভাবে ভালো মনের মানুষ; তবে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অন্তত যে পরিমানের দুর্নীতিবাজ আমলা-কর্মকর্তা আছে; তাদের মারপ্যাচে তিনি নিরুপায় বিধায়ই কোন উত্তরণের ব্যবস্থা হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে- এমনিতেই যেহেতু সমাজে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়া করানোর আগ্রহ অনেক কম; তার উপর আবার শিক্ষাজীবনে ছন্দপতন ঘটায় এবং আর্থিক অসঙ্গতির কারণে নিম্নআয়ের অনেকে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের ব্যয় কমানোর চেষ্টা করবেন। আবার কেউ কেউ ছেলে সন্তানদের পড়াশোনায় ইতি টেনে আর্থিক উপার্জনের জন্য তাদের ছোটোখাট কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন।
একথা সত্য যে, গত কয়েকমাসে তাদের কাছে বিপুল সংখ্যক অভিভাবক তাদের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য এসেছেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এ ধরনের সুযোগ নেই জানানোর পরও তারা নানাভাবে অনুরোধ ও তদবির করেছেন। এসব অভিভাবকদের সবাই করোনাপরবর্তী সময়ে ঢাকা কিংবা বিভিন্ন শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরেছেন বলে জানান তারা। করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকায় মাস দেড়েক আগে তারা শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছেন। শিক্ষার্থীদের এতে অংশ নেওয়ার জন্য এর আগে তারা মোবাইল ফোনে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় অনেক অভিভাবকই তাদের পরিবারে স্থায়ীভাবে ঢাকা ছাড়ার কথা জানান।
অনেক স্কুলেই এমন ঘটনা ঘটছে- করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের চাকরি চলে যাওয়ায় তারা পরিবারসহ স্থায়ীভাবে ঢাকা ছেড়েছেন। আগামীতে তাদের শহরে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় তার লেখাপড়ার ইতি ঘটতে পারে। এ বিষয়টি সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। নিম্নবিত্ত পরিবারের দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে শহর ছেড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের গ্রামের স্কুলে যাতে বিনা ফি-তে ভর্তি করা হয় । এ সংকটের সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া দূরে থাক, তা নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা এখনো শুরু করেনি সরকার বা সংশ্লিষ্ট কোন দপ্তর।
তবে বাংলাদেশে শিক্ষঅ নিয়ে অবিরত কাজ করে যাওয়া আমার মত অসংখ্য শিক্ষা উদ্যেক্তার জন্য দুঃখের খবর হলো- অর্থনীতি সমিতির সাম্প্রতিক জরিপে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে আগের ৩ কোটি ৪০ লাখ উচ্চ মধ্যবিত্ত থেকে মধ্য মধ্যবিত্ত হয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ, ৩ কোটি ৪০ লাখ মধ্য মধ্যবিত্ত থেকে ১ কোটি ২ লাখ হয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত, ৫ কোটি ১০ লাখ নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে এক কোটি ১৯ লাখ দরিদ্র এবং ৩ কোটি ৪০ লাখ দরিদ্র থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ অতিদরিদ্র হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫ কোটি ৯৫ লাখ নতুন করে দরিদ্র ও অতি দরিদ্র হয়েছে। নতুন করে দরিদ্র ও অতি দরিদ্র হওয়া পরিবারের এক শতাংশও গ্রামে ফিরলে এ হিসাবে প্রায় ৬ লাখ পরিবার শহর ছেড়েছে। এদের মধ্যে অনেক পরিবারেই এক বা একাধিক শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। সে হিসাবে শহর ছেড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কোনোভাবেই ৫ লাখের কম নয়। তাই এ বিপুল সংখ্যক শিশু শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে যাতে অন্ধকার নেমে না আসে এ জন্য সরকারকে এখুনি জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা এক বা দুই বছরের জন্য তারা পিছিয়ে গেলে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। যার প্রভাব শুধু শিক্ষাব্যবস্থাই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেও পড়বে।
বাস্তবতার আলোকে কথা বললে-পথ চললে এটা যেমন সত্য- করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বেশ লম্বা একটা সময় ধরে স্থবির হয়ে ছিল গোটা বিশ্ব, সেই সাথে আমাদের বাংলাদেশও; তেমন সত্য- এখনো করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলেও অনেক দেশই লকডাউন তুলে নিতে শুরু করেছে। আমাদের বাংলাদেশেও শর্তসাপেক্ষে অফিস ও গণপরিবহন খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেননা, বেশিদিন তো এই অচলাবস্থা জারি থাকতে পারে না। এমনিতেই যতটা ক্ষতি হয়ে গেছে, তাতে করোনা-পরবর্তী দেশের অবস্থা নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। দেশের অর্থনীতি, কৃষি, উৎপাদন, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান প্রভৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রবল আশঙ্কা।
তবে সবার আগে, গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং এখন অবধি সেগুলো খোলার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। ইউনেস্কো থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের ১৯১টি দেশ জাতীয়ভাবে এবং ৫টি দেশ স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে, যার ফলে বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর ৯৮.৪ ভাগের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বেশিরভাগ আলোচনাতেই যে প্রশ্নটি এখন বারবার উঠে আসছে, তা হলো: অফিস-গণপরিবহন খোলার সিদ্ধান্ত তো হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কবে? ইতঃমধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আদেশ এসেছে যে, আগামী ১৫ জুনের আগে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। তাই অনেকেরই জিজ্ঞাসা, তাহলে কি ১৫ জুনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে? চলছে এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিতর্ক।
এই বিতর্কের বাইরে এসে শিক্ষাবান্ধব বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে কাজ করতে হবে। মেঘ দেখে তুই করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’র কথা মনে রেখে করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য বিধি মেনে ভর্তুকি দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর শিক্ষাকে করা হোক কন্টকমুক্ত। সেক্ষেত্রে তাদের কথা মনে রাখতে হবে যারা শিক্ষাকে ব্যবসা নয়; ব্রত হিসেবে নিয়ে দিনের পর দিন নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন, সেই কিন্ডার গার্টেন ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানে নিবেদিত লাখ লাখ শিক্ষক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদ্রাসা-কওমী মাদ্রাসা-স্কুল কলেজ নিয়ে ভাবেন; কিন্তু কিন্ডার গার্টেন নিয়ে কেবন ভাববেন না? ভাবতে হবে, যারা ছোট ছোট পরিসরে জ্ঞানের আলো পৌছে দিচ্ছেন ঘরে ঘরে তাদেরকে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা করোনাসহায়তা দিবেন, এটিও আমার প্রত্যাশা শিক্ষক হিসেবে, লেখক হিসেবে, বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি