বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো আতঙ্ক কাটেনি নদী তীরবর্তী তিস্তা চরাঞ্চলের মানুষদের। কয়েকদিন পর পর হঠাৎ করেই তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে তিস্তা পাড়ের মানুষদের কষ্ট দুর্দশা।
ভুক্তভোগিরা জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বাঁধ দেয়ার কথা বলে জনপ্রতিনিধিরা ভোট নিচ্ছে। ভোট চলে গেলে বাঁধের কথাও তারা ভুলে গেছে। বন্যা ও নদী ভাঙ্গন দেখা দিলে ওই জনপ্রতিনিধিরা আধা কেজি চিড়া আর ১ শত গ্রাম গুর নিয়ে আসে। ৩০ বছরেও আমরা বাঁধ পাই নাই। তাই আপাতত আমরা বাঁধের স্বপ্ন বাদেই দিয়েছি। নদী ভাঙ্গন আর বন্যার সাথে যুদ্ধ করে আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। ওই এলাকার মহাসীন আলী নামে অপর এ বৃদ্ধ বলেন, আমাদের অন্য স্থানে জমি নেই, যে আমরা বাড়ি ভেঙ্গে চলে যাবো। তাই আমরা ত্রাণ চাই না। আমাদের বাঁধ নিমার্ণ করে দেয়া হোক।
লালমনিরহাটে তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতিরর অনেকটা উন্নতি ঘটেছে। বন্যার পানি নেমে গেলে কয়েকদিনের পানিবন্দি থেকে মুক্তি পায় বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন। তবে পানি কমলেও দুর্ভোগ বেড়েছে বন্যাকবলিতদের মধ্যে। টানা কয়েকদিনের বন্যায় ডুবে থাকায় নষ্ট হয়েছে ঘরবাড়ি ও রাস্তা-ঘাট। নষ্ট হয়েছে আমন বীজতলা, বাদাম ও ভুট্টাসহ নানান জাতের সবজি। বন্যায় নষ্ট হওয়া ঘরবাড়ি মেরামত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এদিকে তিস্তার পানি কমে গেলেও চরাঞ্চলের লোকজনের মাঝে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন আতঙ্ক। সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা, আদিতমারীর কুটিরপাড়, চন্ডিমারী, দক্ষিণ বালাপাড়া, কালীগঞ্জের শৈলমারী চর, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, সিন্দুর্না, ডাউয়াবাড়ি ও গড্ডিমারীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানি কমে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে জেলার শতাধিক বসতবাড়ি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে কয়েকশ ঘরবাড়ি, স্থাপনা ও ফসলি জমি। ভাঙ্গন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তা পাড়ের মানুষের।
লালমনিরহাট জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, সানিয়াজান ও ধরলাসহ বেশ কয়েকটি ছোট ছোট নদী। এই নদী গুলো প্রতি বছর জেলার হাজার হাজার পরিবারকে শুধু গৃহহীনই নয়, একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছে। বন্যায় লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রতক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে। প্রতিবছর জেলায় যে উন্নয়ন হয় তার বেশ কিছু বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিস্তা নদীর ভাঙ্গন ও বন্যা থেকে রক্ষায় বাঁধ নিমার্নের জন্য এ জেলার মানুষ দীর্ঘ ৩০ বছরে ধরে দাবী করে আসলেও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি।
জানা গেছে, তিস্তা নদী জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম হয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। গোটা জেলার ৫ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যায় তিস্তা নদী। ফলে প্রতিবছর বষার্কালে এক দিকে তিস্তা নদীর পানিতে জেলার লক্ষ মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পানি কমে গেলে ভাঙ্গন শুরু হয়। ভাঙ্গনে প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে মানবেতন জীবন যাপন করেন।
তিস্তা নদীর ভাঙ্গন ও বন্যা থেকে স্থায়ী সমাধানের জন্য জেলার মানুষ তিস্তা নদীর বাম তীরে একটি বাঁধ নিমার্ণের দাবী তুলে। সেই দাবীর সাথে একত্বতা ঘোষনা করে রাজনীতির নতুন খেলায় ভোটের ব্যবসা শুরু করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নিবার্চনের সময় থেকেই জনপ্রতিনিধিরা তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্ণের প্রতিশ্রুতি দেয়। নিবার্চনের পরেই তারা ভুলে যায় তাদের নিবার্চনী প্রতিশ্রুতি। গত ৩০ বছরে অনেকেই জনপ্রতিনিধি নিবার্চিত হলেও তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্ণের দাবীটি পুরুন করতে পারে নাই। উল্টো নানা সময় বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে তিস্তা পাড়ের মানুষের সাথে তামাশা করেছেন জনপ্রতিনিধিরা।
সড়ে জমিন ঘুরে দেখা যায়, তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়ন ও হাতীবান্ধা উপজেলায়। এ উপজেলার ৬ ইউনিয়নের অনেক অংশেই নদী গর্ভে চলে গেছে। তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে বসত বাড়ি হারিয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়ে জীবন ও জীবিকার জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চলে গেছেন।
সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা গ্রামের ভাঙনের কবলে পড়া বাদল মিয়া, শরীফ ও রহমত উল্লাহ বলেন, গত ১০ দিনের ব্যবধানে আমাদেরসহ এ গ্রামের ২৫টি বসতভিটা, কবরস্থান, ফসলি জমিসহ বিস্তৃীর্ন এলাকা তিস্তারগর্ভে বিলিন হয়েছে। কেউ পাশে জমি ভাড়া নিয়ে মাথাগুজার ঠাঁই পেলেও অনেকেই রাস্তার ধারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় পরিদর্শন করে বাঁধ নির্মানের আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন নিয়ে শ্বঙ্কা। করোনা ভাইরাস সংক্রামন রোধে বাহিরে বের হতে না পেয়ে অনেকেই অর্থ কষ্টে ভুগছেন। এর মাঝে নদী ভাঙন শুরু হওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে বলেও দাবি করেন তারা। পানিবন্দি ও নদী ভানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ত্রাণ বিতরণ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। পানিবন্দি প্রতি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল, আলু এবং নদী ভাঙ্গনের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য জনপ্রতি ২০ কেজি চাল ও ৭ হাজার টাকা বিতরণ করা হচ্ছে।
দুই বছর আগে তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্ণের দাবীতে একটি গণ-কমিটিথর ব্যনারের আন্দোলন শুরু করেন স্থানীয় যুবকরা। তখন ওই আন্দোলনকে বন্ধ করতে একটি তথ্য প্রচার করা হয়। তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্ণে ৩ শত ৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই সময় আন্দোলনকারীদের একপ্রকার তোপের মুখেও রাখা হয়ে ছিলো। কিন্তু তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্ণে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে এমন কোনো তথ্যেই নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। যৌক্তিক একটি আন্দোলনকে বন্ধ করতেই একটি গুজব প্রচার করা হয় মাত্র।
হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী সাবেক ইউপি সদস্য জাকির হোসেন বলেন, শেখ হাসিনার সরকার ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন এলাকার অনেক উন্নয়ন করছেন। কিন্তু সেই উন্নয়ন তো তিস্তা নদীর ভাঙ্গন ও বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। তাহলে উন্নয়ন করে লাভ কি ? সবার আগে প্রয়োজন উন্নয়নকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। সেই ব্যবস্থা হলো তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্ণ।
তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্ণ আন্দোলন গণ-কমিটিথর সদস্য আসাদুজ্জামান সাজু বলেন, আন্দোলন ছাড়া কোনো কিছু আদায় সম্ভব নয়। আমরা যখন তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্নের জন্য দাবী তুলে জনমত তৈরীতে আন্দোলন শুরু করলাম। ঠিক তখনেই একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হলো যে বাঁধ নিমার্ণে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। যা ছিলো সম্পুর্ণ গুজব। শুধু বাঁধ নয়। প্রতিটি যৌক্তিক আন্দোলনের সময় একটি মহল মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে গুজব ছড়াচ্ছে।
হাতীবান্ধা উপজেলা চেয়ারম্যান মশিউর রহমান মামুন বলেন, তিস্তা নদী লালমনিরহাটের হাজার হাজার মানুষকে প্রতি বছর গৃহহীন করে। তিস্তা নদীর ভাঙ্গনের কারণে জেলার মানচিত্র ছোট হয়ে আসছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নিমার্ণের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা করি আমরা দ্রুত বাঁধ নিমার্ণের সু-সংবাদ পাবো।
লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন বলেছেন, তিস্তা নদীকে শাসন করে বাঁধ নিমার্নের জন্য সরকারের একটি পরিকল্পনা রয়েছে। আমি যখন উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম তখন থেকেই মানুষের জন্য কাজ করে আসছি। মানুষের জন্য এই মুহুতের্ব কি প্রয়োজন তা আমি ভালো ভাবেই জানি। তিস্তা নদীর বাঁধ নিমার্ণের জন্য আমার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সফলতা দেখতে পাবো।