নতুন শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যক্রম নিয়ে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনা এবং প্রকাশকদের একটি অসাধু চক্রের তৎপরতায় এবার নতুন পাঠ্যবই ছাপার কাজে ধীরগতি বিরাজ করছে। প্রকাশক চক্রের সদস্যরা চাচ্ছে কৌশলে নতুন বই ছাপার সব কাজ কব্জা করতে। সেজন্য তারা জোটবদ্ধভাবে সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে দরপত্র জমা দিয়েছে। মাধ্যমিকে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে এবং প্রাথমিকে ২৬ থেকে ৩০ শতাংশ কম মূল্যে দরপত্র জমা দেয়া হয়েছে। তাতে সরকারের টাকা সাশ্রয় হলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা বইয়ের মান রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আর পাঠ্যবই প্রকাশ ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও বইয়ের মান নিয়ে কোন আপোস না করার সরকারের নীতিতে অটল থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু করোনার কারণে নানা সীমাবদ্ধতার সুযোগে এবার নাম-গোত্রহীন কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা ভাল মানের কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে কাজ বাগিয়ে নেয়ার কৌশল নিয়েছে। যার অংশ হিসেবে তারা জোটবদ্ধভাবে সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে দরপত্র জমা দিয়েছে। এনসিটিবি এবং প্রকাশনা শিল্প সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আগামী ২০২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে। তার মধ্যে মাধ্যমিকেরই প্রায় ২৪ কোটি ৭ লাখ বই ছাপানো হবে। মাধ্যমিকের বই ছাপার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। আর প্রাথমিকের বই ছাপার জন্য প্রায় ১০ কোটি ৫৪ লাখ বইয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপার জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১১৫০ কোটি টাকা। কিন্তু মুদ্রাকররা অস্বাভাবিক কম মূল্যে দরপত্র আহ্বান করায় ওই টাকা থেকে সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি সাশ্রয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর প্রাথমিকের সাড়ে ১০ কোটি বই ছাপাতে বিগত বছরের মতো এবারও ৯৮টি লটে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। তাতে বিদেশী দুটি প্রতিষ্ঠানসহ দেশীয় শতাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। দরপত্রের প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা যায়, প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৬ থেকে ৩০ শতাংশ কমে দরপত্র জমা দিয়েছে। তাতে গত বছরের চেয়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। গত বছর প্রাথমিকের একটি বই ছাপতে গড়ে খরচ ২৩ টাকা খরচ হলেও এ বছর তা দাঁড়াচ্ছে ১৮ টাকা ৩২ পয়সা। প্রতি ফর্মা ২ টাকা ১০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে প্রায় ৭০ লাখ কপি বইয়ের চাহিদা কমেছে। তবে কমছে না প্রাথমিক স্তরে বইয়ের সংখ্যা। ওই দুই স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজই বিশেষ সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছে বলে পাঠ্যবই সংশ্লিষ্টরা ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছে। তার আগে সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের শুরুর দিকে বিশেষ একটি চক্র জোটবদ্ধ হয়ে সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে দরপত্র জমা দিতো। তারা কম দামে কাজের কথা বলে নি¤œমানের কাগজে বই ছাপিয়ে সরকারের কাছে হস্তান্তর করতো। তারপর গত কয়েক বছর ধরে সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে চক্রটি সক্রিয় হতে পারেনি। ফলে এই সময়ে নতুন বই ছাপা ও কাগজের মানও ভাল হয়।
সূত্র আরো জানায়, প্রভাবশালী চারজন মুদ্রাকর জোটবদ্ধভাবে সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৫/৩০ শতাংশ কম মূল্যে দরপত্রে অংশ নিয়েছে। তাতে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় অর্ধেক পাঠ্যবই ছাপার কাজ ওই চারজনের কব্জায় চলে যাচ্ছে। ফলে পেশাদার ও সাধারণ মুদ্রাকরদের অনেকেই বই ছাপার কাজ পাচ্ছে না। ওই সিন্ডিকেটে নিষিদ্ধ নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের আশির্বাদপুষ্ট প্রকাশকও রয়েছে বলে। ওসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গত বছরও সরকারের বই ছেপে বিক্রির অনুমোদন নিয়ে নি¤œমানের কাগজের বই ছাপার অভিযোগ রয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের কব্জায়ও এবার বিপুল সংখ্যক বই ছাপার কাজ চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর যোগ্যতাহীন প্রতিষ্ঠান ছাপার কাজ পেলে বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে আবারো প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।
এদিকে প্রাক্কলিত দরের চেয়েও কমে দরপত্র দাখিলকারী মুদ্রাকররা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজ তৈরির পাল্পের দামে দরপতন, নতুন অর্থবছরে বাজেটে কাগজের ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট (২৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ) হ্রাস এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী রফতানি বন্ধ থাকায় টন প্রতি কাগজের দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা কমেছে। সেজন্যই মুদ্রাকর প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের প্রাক্কলিত দামের চেয়ে কম দামে দরপত্র জমা দিয়েছে। এনসিটিবি যখন বইয়ের প্রাক্কলিত দাম নির্ধারণ করে, তখন টন প্রতি কাগজের মূল্য ছিল ৭০ হাজার টাকা; বর্তমানে তা কমেছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি’র বিতরণ নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মোঃ জিয়াউল হক জানান, বই ছাপার ক্ষেত্রে কোন কেলেঙ্কারির সুযোগ নেই। এনসিটিবি এবার অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কেউ খারাপ বই দেয়ার চেষ্টা করেও পারবে না। গত বছর এক মুদ্রাকরের ৩০ হাজার বই বাতিল করা হয়। আরেকজনের ৪০ ফর্মার ৫০ হাজার বই, আরেকজনের ২৬ হাজারের বেশি বই কেটে ফেলা হয়েছিল। এনসিটিবি নিম্নমানের বই নেবে না। চলতি অর্থাৎ ২০২০ শিক্ষাবর্ষে সারাদেশের চার কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৫৮ জন শিক্ষার্থীর কাছে ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৭ কপি পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। তা মধ্যে প্রাথমিকের ১০ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৩৭৫ কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
সার্বিক প্রসঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, এনসিটিবি এখনো কাউকেই কার্যাদেশ দেয়নি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কার্যাদেশ চূড়ান্ত করেনি। কম রেটে বই ছাপা সম্ভব কিনা মূল্যায়ন কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে। এখনো বহু পথ বাকি। বইয়ের মান রক্ষায় সরকার কোন আপোস করবে না। কেবল কম রেটে দরপত্র হলেই হবে না। কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য সকল যোগ্যতা, সক্ষমতা শতভাগ যাচাই-বাছাই করেই দেয়া হবে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সকল কিছু দেখবে। এ ব্যাপারে এনসিটিবি সতর্ক রয়েছে।