দেশের সড়ক-মহাসড়ক খাতে প্রতি বছরই সরকারকে বিপুল টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সর্বোচ্চ ব্যয়ে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের পরও সেগুলো আয়ুষ্কালের অর্ধেক সময়ও টিকছে না। মূলত মালবাহী গাড়ির মাত্রাতিরিক্ত মালামাল পরিবহনের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে পণ্য পরিবহনে সরকারের ‘এক্সেল লোড নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা কেউ মানছেন না। ফলে বহনক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচলের কারণে সড়ক-মহাসড়ক ও সেতুর ক্ষতি হচ্ছে। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা নির্মাণ করে কোনো লাভ হবে না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাড়তি ওজন নিয়ে সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচলের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। অতিসম্প্রতি অতিরিক্ত সিমেন্ট বোঝাই করে পারাপারের সময় ট্রাকসহ বগুড়ার সারিয়াকান্দির বেইলি ব্রিজ ভেঙে পড়ে। তার আগে ২০১৭ সালে অতিরিক্ত পাথরবোঝাই দুটি ট্রাক পিরোজপুরের ভা-ারিয়া উপজেলার মাদার্সী সেতুতে একই সঙ্গে উঠলে সেতুটি ভেঙে পড়ে। চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল-বানারীপাড়া সড়কে বালুবোঝাই একটি ট্রাক বেইলি সেতু পার হতে গিয়ে সেতু ভেঙে খালে পড়ে যায়। অতিরিক্ত ওজনের কারণে প্রায়শই এ রকম সেতু ভেঙে পড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। অতিলোভের কারণে পণ্যবাহী যানের চালক ও শ্রমিকেরা ওজনসীমার অতিরিক্ত মালামাল পরিবহন করে। আর যাদের এসব বিষয় তদারকির দায়িত্ব সেদিকে তাদের নজর নেই।
সূত্র জানায়, সরকার বাড়তি ওজনের গাড়ি নিয়ন্ত্রণে ১ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের মহাসড়কগুলোতে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রক সেল বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আর এ উদ্যোগের জের ধরে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মালিকরা বলছেন, সরকারের ওই উদ্যোগের ফলে পণ্য পরিবহনে ভাড়া বাড়বে। সড়ক-মহাসড়কে শুধু ওজন নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসালেই হবে না, যন্ত্রের কাছে বাড়তি ওজনের পণ্য রাখার মতো গুদামঘরের ব্যবস্থাও করতে হবে। তাছাড়া দেশের অনেক স্থানেই মানহীন সড়ক নির্মাণ করা হয়। তার ওপর দিয়ে প্রায়ই দেখা যায় পাঁচ টনের ট্রাকে বহন করা হচ্ছে ১০-১২ টন মালামাল। তাতে সড়ক, মহাসড়ক ও ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সড়কের কয়েকটি স্থানে ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে যন্ত্র বসানো হলেও তা ঠিকভাবে এখনো কার্যকর হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়তি ওজনের পণ্যবাহী যান থেকে টাকা নিয়ে তা চলতে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, গাড়ির লোডিং সিস্টেম যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা নির্মাণ করে কোনো লাভ হবে না। ওভারলোড গাড়ি চললে সড়কের ক্ষতি হবেই। স্কেল ব্যবহার করার মাধ্যমে লোডিং নিয়ন্ত্রণ করা গেলে প্রথমতা সড়কের ক্ষতি কম হবে, দ্বিতীয়ত গাড়ির ক্ষতি কমে আসবে এবং তৃতীয়ত সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। বিগত ২০১২ সালের ১১ জুন মোটরযানের এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র পরিচালনা সংক্রান্ত একটি নীতিমালা অনুমোদন হয়ে ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর রয়েছে। ওই নীতিমালায় মহাসড়কে চালাচলকৃত ছয় চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ২২ টন, ১০ চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ৩০ টন এবং ১৪ চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ৪০ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই নীতিমালা না মানলে দুই থেকে ১২ হাজার জরিমানা গুনতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও ওই নীতিমালা মোটেও মানা হচ্ছে না।
এদিকে পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালামাল পরিবহনের ওৎনসীমা উৎসমূলেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং পরিবহন এজেন্ট পর্যায়ে কার্যকর মনিটরিং জরুরি। কিন্তু অতিরিক্ত মালামাল বহনের বিষয়টি যারা তদারিক করার কথা তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে না। এ যাবতকালে দেশে যেসব বেইলি ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, অতিরিক্ত ওজনের কারণে তার সিংহভাগই ঘটেছে। তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং ওভার লোড বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না। বর্তমানে দেশের ২১টি মহাসড়কে নতুন করে ওজনসীমা নিয়ন্ত্রণ স্কেল বসানোর কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেগুলো বসানো হলে সুফল মিলবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর সদর, কেরানীগঞ্জ, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, বুড়িচং, ফেনী সদর, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম সদর, সীতাকু-ু, মাধবপুর, বিয়ানীবাজার, রামপাল, সাতক্ষীরা সদর, দামুড়হুদা, শিবগঞ্জ, হাকিমপুর, রৌমারী, তেঁতুলিয়া, সৈয়দপুর, শিবচর ও কালিহাতী উপজেলায় নতুন ওজন স্কেল বসানো হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, বর্তমানে এক্সেল লোড-সংক্রান্ত নীতিমালা কার্যকর রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ওজনসীমা নিয়ন্ত্রণ স্কেল বসানো হয়েছে। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আরো ওজনসীমা নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন প্রক্রিয়াধীন আছে। পাশাপাশি সেতুগুলোতে ওভারলোড যানবাহন না চালানোর জন্য মোটরযানের মালিক-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মন্ত্রী অনুরোধ জানিয়েছেন।