ভিন্ন এক বাস্তবতায় ক্ষেত থেকে পাট উঠতে শুরু করেছে। গত বছর কৃষক গড়ে প্রায় দুই হাজার টাকা মণপ্রতি পাটের দর পেয়েছে। আগামী সপ্তাহেই হাটে নতুন পাট উঠতে শুরু করবে। পাটের পরিমাপ সাধারণত বেল আকারে করা হয়। ১৫০ কেজিতে এক বেল গণনা করা হয়। সরকার প্রতি বছর গড়ে ১৩ লাখ বেল পাট কিনে থাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে দেশের সব সরকারি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সরকারি পাটকল আর পাট কিনবে না। বরং ওসব মিলের হাতে থাকা মজুদ পাট বিক্রি করতে হবে। এমন অবস্থায় কৃষক কোথায় পাট বিক্রি করবে। আর বেসরকারি পাটকলগুলোই কতটুকু পাট কিনবে? এমন পরিস্থিতিতে পাটের ন্যায্য দাম শঙ্কায় ভুগছে কৃষকরা। বিজেএমসি, পাট চাষী এবং পাটখাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত বছর দেশে ৬৮ লাখ বেল পাট উৎপন্ন হয়েছিল। চলতি মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৮২ লাখ বেল পাট। এবার মোট ৭ দশমিক ২৬ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত ১৮ শতাংশ পাট কাটা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাটে পুরোপুরি পাট উঠতে শুরু করবে। দেশে প্রায় ৪০ লাখ চাষি পাট চাষ করেন। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাটকে কেন্দ্র করে চলে ৪ কোটি মানুষের জীবিকা। প্রতি বছর মৌসুমে গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পান কৃষক। দেশের প্রায় সব জেলাতেই পাট উৎপন্ন হয়। তবে বেশি উৎপন্ন হয় ফরিদপুর, যশোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলায়। বিদ্যমান অবস্থায় ওসব জেলার পাটচাষিদের মধ্যে পাট বিক্রি এবং ন্যায্য দর পাওয়া নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকার এবার পাট কিনবে না শুনেই পাটচাষীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ বেসরকারি উদ্যোক্তারা গতবারের তুলনায় এবার বেশি করে পাট না কিনলে দাম পড়ে যাবে। ইতোমধ্যে হাটেও পাট নিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। কিন্তু সরকারি পাটকল বন্ধ থাকায় বাজারে পাটের দাম কম। পাশাপাশি করোনার কারণে পাট কাটা ও আঁশ ছাড়ানোর জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। সেজন্য অন্য বছরের তুলনায় উৎপাদনের খরচও বেশি হচ্ছে। প্রতিবিঘা পাট উৎপাদনে বীজ, সার, ওষুধ, সেচ, পাট কাটা ও পাটের আঁশ ছাড়ানো দিয়ে মোট ব্যয় আছে ২০ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি পাট উৎপাদন ৯ থেকে ১০ মণ। পাটের দরের সঙ্গে হিসাব করলে খুব বেশি লাভ হয় না। তার ওপর যদি সরকার পাট না কিনে তাহলে কষ্টের সীমা থাকবে না। বর্তমানে বাজারে পাটের চাহিদা কম। দুই হাজার টাকার বেশি দর পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর মণপ্রতি দুই হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত দর পেয়েছে চাষীরা। এবার প্রতি মণ পাটের মূল্য কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা হলে চাষীরা কিছুটা লাভবান হতো।
সূত্র আরো জানায়, অনুমোদিত ৪৮ এজেন্সির মাধ্যমে সরকারি পাটকলে পাট আসতো। এখন সরকারি পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেসরকারি কলগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করবে। পাটের দরও তারা ইচ্ছামতো নির্ধারণ করবে। ফলে কৃষক ন্যায্য দর থেকে বঞ্চিত হবে। গত কোরবানির ঈদে চামড়া নিয়ে যে রকম অরাজক পরিস্থিতি হয়েছিল, এবার পাট নিয়েও সেই একই অবস্থা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে পাটচাষে আগ্রহ হারাবে চাষি। তাতে অর্থনীতি অর্থাৎ দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোতে উৎপাদিত পাটের ৫০ থেকে ৫৫ লাখ বেল ব্যবহার হয়। স্থানীয় বাজার থেকে ফড়িয়া এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা বছরের পাট সংগ্রহ করে বেসরকারি খাতের মিলগুলো। তবে সরকারি পাটকলের মতো বড় আকারের গুদাম না থাকায় তাদের পক্ষে মৌসুমে প্রয়োজনীয় পাট কেনা সম্ভব হয় না। তারা মূলত গুদাম আছে এমন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাট কেনে। আর তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পক্ষে এ বছর বেশি পাট কেনা সম্ভব হবে না। তবে এত দিন অভ্যন্তরীণ এবং রপ্তানি বাজারে সরকারি খাতে যতটুকু অংশ ছিল, তারা সেটা পর্যায়ক্রমে পূরণ করার চেষ্টা করবেন।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ বছর পাট নিয়ে কৃষকের সমস্যা হবেই। কারণ বেসরকারি খাতে কাঁচাপাট রপ্তানি বাড়ানোর যে সুযোগ আছে, তা কাজে লাগাতে আগে থেকেই প্রস্ততির প্রয়োজন ছিল। হঠাৎ করেই রপ্তানি বা বিক্রি বাড়ানো সম্ভব হবে না। তবে এখন থেকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ওই প্রক্রিয়া শুরু করলে আগামী বছর থেকে কাঁচাপাট রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে। পাশাপাশি সরকার পাট না কেনার প্রেক্ষাপটে কাঁচাপাট রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা এ বছর অন্যবারের তুলনায় বেশি রপ্তানির চেষ্টা করবে। তবে চাইলেই রপ্তানি করা সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান বলছে, কাঁচাপাট রপ্তানির পরিমাণ কমছে। ২০১২-২০১৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ বেল কাঁচাপাট রপ্তানি হতো। বছর বছর কমে তা ৮ থেকে ৯ লাখ বেলে নেমে এসেছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ বেল। সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরো কমে তা ৬ লাখ ১৪ হাজার বেলে নেমে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে কাঁচাপাট রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সভাপতি এস কে সৈয়দ আলী জানান, বন্যায় কিছুটা ক্ষতি হলেও পাটের আবাদ এবার ভালো হয়েছে। সরকার তো এ বছর পাট কিনবে না। এ কারণে এবার রপ্তানি বৃদ্ধির চেষ্টা করা হবে।
একই প্রসঙ্গে বিজেএমসির চেয়ারম্যান আবদুর রউফ জানান, এবার পাট কিনবে না সরকার। এই বাবদ বরাদ্দও রাখা হয়নি; বরং হাতে মজুদ পাট বিক্রি করতে হবে। বন্ধ মিলগুলোতে কী পরিমাণ পাট মজুদ আছে, এখন ওই হিসাব করা হচ্ছে। তবে কৃষক যাতে ন্যায্য দর থেকে বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক আছে সরকার। সরকার পাট না কিনলেও পাট বিক্রি ও রপ্তানির অনেক পথ রয়েছে। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। তবে খুব প্রয়োজন মনে করলে সরকার কিনতেও পারে। সরকারি পাটকলগুলোর গুদাম খালি পড়ে আছে। সেখানে পাট রাখা যাবে। আবার সময়মতো ক্রয় মূল্যে বিক্রি করা যাবে। প্রয়োজনে কিছু ভর্তুকি দিয়েই বিক্রি করা যাবে।