দেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার ভুয়া ডাক্তার। তারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে। স্বাস্থ্য সেবার নামে দীর্ঘদিন ধরে এমন প্রতারণা অব্যাহত থাকলেও তা প্রতিকারে অদৃশ্য কারণে নিরব সাস্থ্য অধিদফতর। ওসব ভুয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার নজির নেই বললেই চলে। ফলে ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের ছড়াছড়ি এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের দৌরাত্ম্য সীমাহীন বাড়ছে। বিভিন্ন আইটেমের বাহারি ডিগ্রি ব্যবহার করে চকচকে সাইন বোর্ড সাঁটিয়ে নিরীহ রোগীদের প্রতারিত করছে তারা। ফলে চিকিৎসা সেবায় চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রোগীদের জীবন ও জনস্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। আর এভাবে অল্প সময়েই নিভে গেছে অনেক জীবন প্রদীপ। বছরের পর বছর ধরে ভুয়া ডাক্তারকেন্দ্রিক নানা অরাজকতা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও তা প্রতিকারে সরকারের দায়িত্বশীল বিএমডিসি, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিএমএসহ ডাক্তারদের পেশাদার সংগঠনগুলো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এমনকি ভুয়া ডাক্তারদের নানা দৌরাত্ম্যের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা অজ্ঞাত কারণে ধামাচাপা দিয়ে রাখছে। জাল সনদ এবং নবায়নহীন লাইসেন্সকে পুঁজি করে ভুয়া ডাক্তাররা রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা সদরে অভিজাত চেম্বার সাজিয়ে অহরহ রোগীদের সাথে প্রতারণা করে চলছে। ভুয়াদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। বরং জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর রুটিন অভিযান চালানো থেকেও বিরত থাকছে।
সূত্র জানায়, বাণিজ্যের লক্ষ্যে সাইনবোর্ডে ভুয়া ডাক্তাররা নামের পেছনে এফআরএসএইচ, এমএসিপি, এফএসিপি, পিজিটি, এমডি ও এফসিপিএস (ইনকোর্স) ও পার্ট-১ অথবা পার্ট-২সহ বিভিন্ন ডিগ্রি লাগাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভুয়া ডিগ্রির সঙ্গে লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামও উল্লেখ করা হয়। ফলে সাধারণ রোগীরা স্বাভাবিকভাবেই ওসব ডাক্তারকে বিদেশি ডিগ্রিপ্রাপ্ত বলে মনে করছে। এতো ডিগ্রি দেখে সরল মনে ভুয়া ডাক্তারদের দেখানোর জন্য রোগীরা ভিড় জমায়। আর এ সুযোগে ভুয়া ডাক্তাররা রোগীপ্রতি ফি নামে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে নিজেদের এমন সব পদ-পদবির পরিচয় ব্যবহার করে, যার কোনো অস্তিত্বই নেই। পাশাপাশি বিএমডিসি আইনে অনুমোদন করে না ওই রকম পদ-পদবি ও ডিগ্রিরও ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, চিকিৎসা সেবার নামে দেশজুড়ে ১৪ হাজারেরও বেশি ভুয়া এমবিবিএস ডাক্তার ছড়িয়ে পড়েছে। যারা অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়ে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সকে পুঁজি করেই চিকিৎসা বাণিজ্য চালাচ্ছে। ভুয়া ডাক্তাররা মূলত টাকার বিনিময়ে নকল সার্টিফিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ চিকিৎসকদের লাইসেন্স দেয়ার একমাত্র প্রতিষ্ঠান বিএমডিসি। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান বিএমডিসিকে অনুকরণ করে বিসিএমডিসি নাম দিয়ে ভুয়া লাইসেন্সের কারবার চালাচ্ছে।
এদিকে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযানে একের পর এক ভুয়া ডাক্তার ও ভুয়া বিশেষজ্ঞ আবিষ্কৃত হচ্ছে। তাদের নানা রকম শাস্তিও দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালে টানা ১২ বছর চিকিৎসা প্রদানকারী নকল সনদের দাপুটে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। র্যাবের এক অভিযানে মানিকগঞ্জে এসএসসি পাস করা এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সন্ধান মিলেছে। ভুয়া ডাক্তারের পাশাপাশি জাল ডিগ্রিধারী ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের’ সংখ্যাও কম নয়। তারা এমবিবিএস ডিগ্রির আগে পিছে দেশ-বিদেশের ভুয়া, নকল, মনগড়া উচ্চতর সব ডিগ্রি ব্যবহার করে বছরের পর বছর রোগী দেখছে, হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের ফি। ভুয়া ডাক্তার-দালালদের দৌরাত্ম্য, ভুল চিকিৎসা, অবহেলা আর চিকিৎসা বাণিজ্যের নির্মমতায় একের পর এক রোগী মারা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের উদ্যোগে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অর্ধশতাধিক ভুয়া ডাক্তারকে আটক এবং তাদের জেল-জরিমানা করা হয়েছে। ভুয়া ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যের কথা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সবাই জানেন। কিন্তুকেউ তাদের দৌরাত্ম্য রোধকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা সেক্টরে ভুয়া ডাক্তার ও অপচিকিৎসা ব্যবস্থাটি বছরের পর বছর ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতোই চেপে আছে। তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে বিএমডিসিকে ঢেলে সাজানোসহ শক্তিশালীকরণের বিকল্প নেই। ভুয়া ডাক্তাররা প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করে এবং কৌশলে সহজ সরল মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে থাকে। বর্তমানে চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও খুলনা মহানগরীতে ভুয়া ডাক্তারসহ বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ফার্মেসিতে র্যাবের মোবাইল কোর্টের অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং ভুয়া ডাক্তার শনাক্ত হচ্ছে।