বিদেশী অপরাধী চক্র এদেশেই বৈধ-অবৈধভাবে বসবাস করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর লোভের বশে এদেশেরই কিছু লোকজন তাদের সহযোগিতা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে দুই লাখের বেশি বিদেশী নাগরিক বৈধ-অবৈধভাবে বসবাস করছে। তার মধ্যে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী অপরাধী চক্রের সদস্যরা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে করোনাকালে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অপরাধের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং দেশীয় লোকজনের সহায়তায় হাতিয়ে কোটি কোটি টাকা নিচ্ছে। গত দুই মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে অন্তত অর্ধশতাধিক বিদেশী প্রতারক চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা রাজধানী ঢাকাসহ দেশে অবস্থানরত ১০ দেশের প্রায় এক হাজার অবৈধ বিদেশী নাগরিকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ও অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশীদের বিরুদ্ধে র্যাব, পুলিশ, সিআইডি ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে নামছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, খোদ রাজধানীতেই সহ¯্রাধিক অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশী নাগরিক প্রতারণা, ক্রেডিটকার্ড জালিয়াতি, জঙ্গি তৎপরতা, আদম পাচার, জাল ডলার ব্যবসা, মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে। বিদেশী অপরাধীরা ইন্টারনেটে, ফেসবুক, ই-মেইল, হোয়াটএ্যাপ, মেসেঞ্জারসহ নানা ধরনের পদ্ধতিতে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। আর তাদের সহায়তা করছে অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিছু এদেশের নাগরিক। সম্প্রতি রাজধানীতে এক বাংলাদেশী নারীসহ ১২ বিদেশী নাগরিককে আটক করে সিআইডি। গেস্খফতারকৃতদের তথ্য মতে, ওই ফেসবুকে বন্ধুত্বের পর দামী উপহার দেয়ার নামে সারাদেশ থেকে শতাধিক ভুক্তভোগীর সাথে প্রতারণা করে গত কয়েক মাসে ৫-৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে ৫টি ল্যাপটপ, ১৪টি বিভিন্ন মডেলের মোবাইল ফোন এবং অসংখ্য সিম উদ্ধার করা হয়।
সূত্র জানায়, একটি বিদেশী অপরাধী চক্র রাজধানী ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে অনলাইন জুয়ার আসর বসিয়ে মাত্র ৪ মাসে ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই টাকায় কেনা হয়েছে দামী গাড়ি এবং ফ্ল্যাট। আবার কয়েক কোটি টাকা বিদেশেও পাচার করা হয়েছে। চট্টগ্রামে অনলাইন জুয়াড়ি দলের ৫ সদস্যকে আটকের পর চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য বের হয়ে আসে। গোয়েন্দা পুলিশ নগরীর বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে নগদ আড়াই লাখ টাকা, ১টি প্রাইভেট কার এবং ৩টি ল্যাপটপসহ তাদের গ্রেফতার করেছে। তাছাড়া চক্রটি বিভিন্ন এ্যাপস এবং ওয়েবসাইট ব্যবহার করেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পুলিশের তথ্য মতে, বিশেষায়িত ৩টি ওয়েবসাইট এবং কয়েকটি এ্যাপসের মাধ্যমে অন লাইন জুয়া চলতো। আবার আয়ের অংশ কয়েক কোটি টাকা অনলাইন মুদ্রা বিটকয়েনে কনভার্ট করে ইউক্রেনের মাফিয়াদের কাছে পাঠানো হয়। সিআইডি এখন বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।
সূত্র আরো জানায়, অবৈধভাবে বা বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী প্রতারক চক্রের প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতারের পর পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) বিদেশী নাগরিকের ডাটাবেজ তৈরির কাজ করছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের তথ্যানুযায়ী, গত তিন মাসে প্রায় ১ হাজার বিদেশীর ওপর অনুসন্ধান ও নজরদারি করা হয়। ডাটাবেজ অনুযায়ী দেশে প্রায় দুই লাখ বিদেশী অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১৭ হাজার আফ্রিকানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক রয়েছে, যারা দেশের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের মধ্যে সহস্রাধিক বিদেশী নাগরিককে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার তথ্য ও তালিকা পাওয়া গেলেও তাদের ওপর যথাযথ নজরদারি নেই। অবৈধ বিদেশীরা কোথায়, কী ধরনের কাজ করছে, অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিনা সেই বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি বা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ নেই।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১১ হাজার বিদেশীকে চিহ্নিত করেছে সরকার। তাদেরকে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওসব নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কোন উদ্যোগ নেয়নি। কিছু দেশের দূতাবাসও বাংলাদেশে নেই। তাই তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া জটিল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে আফ্রিকাসহ নানা দেশের নাগরিক ভিসা নিয়ে বৈধভাবে বাংলাদেশে এসেছে, এমন ১১ হাজার নাগরিকের তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যাদের ভিসা এবং পাসপোর্ট কোনটিরই মেয়াদ নেই। তাদের কিছু সংখ্যক অপরাধে জড়িয়ে কারাগারে বন্দী রয়েছে আবার কিছু সংখ্যক অবৈধভাবে বসবাস করছে। তাদের আবার কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রতারণার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী চক্রের তৎপরতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানসান, বাংলাদেশে যেসব বিদেশী বসবাস বা অবস্থান করছে তাদের মধ্যে কালো আফ্রিকান নাগরিক যারা, তারাই বেশিরভাগ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আফ্রিকা অঞ্চলের কিছু মানুষ তাদের পাসপোর্ট ফেলে দিচ্ছে। তার পর তাদের অবস্থানে সহযোগিতা করছে স্থানীয় কিছু অর্থলোভী নারী-পুরুষ। শুধু তাই নয়, অপরাধেও মদদ জোগাচ্ছে। কেউ ধরা পড়েও জামিনে বেরিয়ে ফের অপরাধে জড়াচ্ছে। তবে বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশী অপরাধীদের শনাক্ত করার পর তালিকা তৈরি করে ফেরত পাঠানোসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে কী করণীয় তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।