দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য থাকা সত্ত্বেও ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে যেমন রয়েছে কিছু সাদৃশ্য, তেমনি দর্শন ও সাহিত্যের মধ্যেও রয়েছে বেশকিছু অভিন্নতা। বিশেষ করে এখানে আলোচনা করতে চাই দর্শন ও কাব্যের সম্বন্ধ নিয়ে। কবি কথার অর্থ ক্রান্তদর্শী। কোনো বস্তুর শেষ সীমা দেখার ক্ষমতা যার আছে তিনিই কবি, তিনিই ক্রান্তদর্শী। দার্শনিকের লক্ষ্যটাও অনেকটাই তা-ই। দর্শন জগৎ ও জীবনের পরমতত্ত্বের অনুসন্ধানে নিয়োজিত। দর্শনের যেমন, সাহিত্যেরও তেমনি উপজীব্য জগৎ ও জীবন। তবে তাদের আলোচনার পদ্ধতি ভিন্ন। দর্শন অগ্রসর হয় যৌক্তিক চিন্তা ও সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের পথে, আর সাহিত্য, বিশেষত কাব্য (ঢ়ড়বঃৎু) প্রধানত নির্ভর করে অনুভব বা হৃদয়াবেগের ওপর। দর্শন তার বিষয়বস্তুকে পরিমাপ করে যুক্তির নিরিখে, আর কাব্য-সাহিত্যের আবেদন ও ভাবাবেগ আপ্লুত হৃদয়তন্ত্রীর দরবারে। অন্যভাবে বলা যায়, দার্শনিক চিন্তার বাহন মস্তিষ্ক, আর কবির অবলম্বন হৃদয়।
এসব সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের কথা মাথায় রেখেই বলা যায়, দর্শন ও কাব্যের সম্বন্ধ দূরত্বের সম্বন্ধ নয়, বরং খবুই নিকট ও নিবিড়। এ জন্যই দেখা যায়, পৃথিবীর আদি রচনাবলির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যুগপৎ স্বীকৃতি পেয়েছে সাহিত্য ও দর্শন বলে, বেশকিছু লেখক নন্দিত হয়েছেন একাধারে কবি ও দার্শনিক হিসেবে। যেমন, মূলত ধর্মকথা হয়েও উপনিষদের শ্লোকসমূহ স্মরণীয় হয়ে আছে সার্থক কাব্য হিসেবে।
বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদনামে পরিচিত। দার্শনিক রীতিতে এবং বিস্তৃত যুক্তির আঙ্গিকে পরিবেশিত না হলেও এসব গীতি-রচনায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় জগৎ ও জীবনের এমন কিছু দুর্জ্ঞেয় তত্ত্বের যেগুলো বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের আধুনিক দার্শনিক সাহিত্যে। ভাষার দীনতা সত্ত্বেও বাগ-বৈদগ্ধের কৌশলে, ছন্দ ও অলঙ্কারগত সৌন্দর্যের সংগঠন এবং বিষয়বস্তুর বাস্তবধর্মিতায় চর্যাপদগুলো নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয় দার্শনিক কীর্তির দর্শন।
চর্যাপদে যে সাধনপদ্ধতির উল্লেখ দেখা যায় তার জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অধিবিদ্যক (সবঃধঢ়যুংরপধষ) ব্যঞ্জনা পাশ্চাত্যের কিছু দার্শনিক মতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নমুনা হিসেবে এখানে ১৫নং চর্যার কিছু অংশ উল্লেখ করছি। এখানকার মূল বক্তব্যটা এরকম: ‘স্বরূপ বিচারে স্বীয় সংবেদন অলক্ষ্যÑ তার লক্ষণ জানা যায় না। যারাই ঋজুপথে গিয়েছে, তারাই ফিরে আসেনি। ... বালকের মতো এটা ওটায় ভুল করে সামনে নৌকা-ভেলা কিছুই যদি না দেখতে পাও ভুল করে ‘নাথ’কে (গুরুকে) কেন জিজ্ঞাসা করো না।
সত্তা (নবরহম) ও অবভাসের (ধঢ়ঢ়বধৎধহপব) পার্থক্য নির্দেশের প্রচলন দর্শনের ইতিহাসে সুপ্রাচীন। চর্যাপদেও এ দার্শনিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন লক্ষণীয়। যেমন ৫নং চর্যায় পদকর্তা চাটিল বলেন :
ভবনই গহন গম্ভীর বেগে বাহী।
দু আন্তে চিখিল মাঝে ন যাহী ॥
অর্থাৎ ‘এই সংসারপ্রবাহ নদীপ্রবাহের মতোই গম্ভীর মায়ামোহ রচনা করে প্রবাহিত হচ্ছে। তার দু’পাশে রয়েছে অনাপেক্ষিক নিবৃত্তি এবং ঐকান্তিক প্রবৃত্তির পঙ্ককু-, মায়ামুগ্ধ চিত্ত যাতে আটকা পড়তে পারে যে কোনো মুহূর্তে।
এখানে যে অধিবিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় তাহলো এরকম : নদীস্রোতের প্রতীতি মায়াময়। নদীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা যেমন খ-িত এবং একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন, তেমনি আমরা যাকে সংসার বলি তা-ও বুদবুদের মতো অসংখ্য খ-িত মুহূর্তের মায়ারূপ বিশেষ। সংসারের বিভিন্ন খ-িত ঘটনা আমাদের চেতনা ও চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে, অখ- স্থায়িত্বের প্রতিভাস সৃষ্টি করে, কিন্তু পরমসত্তার সন্ধান দেয় না, দিতে পারে না। চাটিলের মতে, গম্ভীর বেগে প্রবাহিত এ ভবনদীর একটিকে ছেড়ে যেই আমরা অপরটির শরণাপন্ন হই, অমনি আমরা বিচ্যুত হয়ে পড়ি যথার্থ জ্ঞান, পরমসম্য ও পরমার্থের পথ থেকে। অবভাস ও সত্তার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ এবং সেই মর্মে জীবন পরিচালনা মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য।
দার্শনিক ও কবির স্বরূপ-লক্ষণ প্রসঙ্গে এ কথা বলে রাখা দরকার যে যিনি শুধু কবি, দার্শনিক নন, তিনি তার কাব্যে জগৎ ও জীবনের কিছু বিবরণ দেনমাত্র। আর যিনি একাধারে কবি ও দার্শনিক (ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যবৎ-ঢ়ড়বঃ) তিনি তার কাব্যে জগৎ ও জীবনের নিছক বর্ণনা দেন না, ছন্দ-যুক্তির সমন্বয়ে হাজির করেন এক চমৎকার ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন। লুক্রেটিয়াস, ওমর খৈয়াম, দান্তে, গ্যেটে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবীন্দ্রনাথ, ইকবালÑ এরা সবাই ছিলেন দার্শনিক-কবি। লুক্রেটিয়াস তার কাব্যে পরিবেশন করেছেন জগতের এক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা এবং প্রয়াজনবোধ করেছেন দেব-দেবীর ভীতি থেকে মানুষকে মুক্ত করার। তার এ বক্তব্য একদিকে কাব্যিক উৎকর্ষ এবং অন্যদিকে দার্শনিক শৃঙ্খলার এক চমৎকার নিদর্শন। অনুরূপভাবে ওমর খৈয়ামের কাব্যে জগতের যে সুখবাদী-বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দেখা যায়, তা যুগপৎ সাহিত্যিক প্রসাদগুণ এবং দার্শনিক তত্ত্বগাম্ভীর্যের প্রতীক।
তার চেয়ে আরো পাকাপোক্ত দার্শনিক-কবি হিসেবে উল্লেখ করতে হয় দান্তের নাম। ডিভাইন কমেডি নামক তার কাব্যগ্রন্থে তিনি জগৎ সংসারের কাঠামো ও সত্তা, মানুষের উৎপত্তি প্রকৃতি পরিণতি, অকল্যাণের হেতু এবং এ থেকে অব্যাহতি লাভের উপায় প্রভৃতি মৌলিক বিষয়ের এক চমৎকার দার্শনিক ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তার মতে, স্বর্গীয় প্রেমের দীপ্তি নিঃসৃত হয় জগতের মর্মমূল থেকে। আর এ প্রেমের লক্ষ্য হলো মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করা। একই পাপমুক্তির কথা বলেছেন গ্যেটে। তার মতে, এ মুক্তি আসে অভিজ্ঞতা থেকে, উৎসর্গ কিংবা আনুগত্য থেকে নয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থের দৃষ্টিতে দুনিয়া হাড়ে হাড়ে দুর্জ্ঞেয় এবং এখানকার সবকিছুই ভারি ও ক্লান্তিকর বোঝার মতো। অন্যদিকে ব্রাউনিং তার কাব্যে বয়ে এনেছেন ঈশ্বর, প্রেম ও সত্যে বিশ্বাসের বাণী।
আল্লামা ইকবাল তার কাব্যে মানুষের ব্যক্তি (খুদি), স্বাতন্ত্র্য, আল্লাহর স্বরূপ পারমার্থিক জ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের যে দার্শনিক ব্যাখ্যা দেন, তা তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন বিখ্যাত দার্শনিক কবি হিসেবে। এ প্রসঙ্গ তার আসরার-ই-খুদি ও রুমুজ-ই-বিখুদি-এ দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে আত্মসত্তার (খুদি) ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইকবাল দর্শনের সমগ্র কাঠামো, তা-ই বিশদভাবে বিধৃত হয়েছে এ দুটি ফার্সি কাব্যগ্রন্থে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ক্রমবিকশিত হয়েছে ধর্মীয় প্রত্যয় ও অনুভূতিকে কেন্দ্র করে। স্বাভাবিক কারণই তার কবি হৃদয়ে যুক্তির চেয়ে অনুভূতি ছিল প্রবল। কিন্তু তাই বলে হৃদয়াবেগের চাপে তিনি দার্শনিক যুক্তির পথ পরিহার করেননি। সসীম ও অসীমের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি যে কবিতার অবতারণা করেছেন নিঃসন্দেহে তা যুগপৎ স্বীকৃতি পায় অনবদ্য কাব্য ও যথার্থ দর্শন হিসেবে। উপনিষদের ব্রহ্মের কথাই বলি, ভক্তের ভগবানের কথাই বলি কিংবা তার নিজের জীবন দেবতার কথাই বলি, এদের সবাইকেই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের মনে ও প্রকৃতিতে অনুসৃত সত্তারূপে। কবিগুরুর ভাষায় :
জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্র রূপিণী।
একই ভাব প্রকাশিত হয়েছে এ কয়েকটি চরণে :
সীমার মাঝে, অসীম তুমি
বাজাও আপন সরি।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
তাই এত মধুর।
রবীন্দ্রনাথ জগৎসংসারকে দেখেছেন এক অনন্ত প্রেমের লীলা হিসেবে। আবার সসীম মানুষকেও তিনি পরামর্শ দিয়েছেন প্রেমের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হতে এবং পূর্ণতার সাধনা দ্বারা সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র মানবতার কল্যাণসাধনে ব্রতী হতে। তার মতে, পরমসত্তা সর্বব্যাপ্ত। আমরা সবাই তারই অংশ। সুতরাং একক মনুষ্যত্বের মধ্যে মুক্তি নেই, মুক্তি নিহিত সমগ্র মানবসংসারের পরিপূর্ণ প্রকাশে। একটি প্রদীপ যেমন রাতের অন্ধকার ঘুচাতে পারে না, তেমনি একক ব্যক্তির চেষ্টায়ও সাধিত হয় না বৃহত্তর সমাজের কল্যাণ। এর জন্য প্রয়োজন সব মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতা।
পরিশেষে এ-ও বলে রাখা দরকার, দর্শনের পথ যুক্তিবিচারের পথ সন্দেহ নেই। কিন্তু কেবল যুক্তি দিয়ে মনকে নিঃসংশয়, দ্বিধামুক্ত ও পরিতৃপ্ত করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন অখ- অনুভূতি ও অনাবিল হৃদয়াবেগ, যা-কিনা কাব্যসাহিত্যের মূল অবলম্বন। যে রচনায় একদিকে সাহিত্যিক আনন্দ-অনুভূতি এবং অন্যদিকে দার্শনিক যুক্তিবিচারের সার্থক সমন্বয় ঘটে, সে রচয়িতাই মর্যাদা পায় সুসাহিত্য ও প্রকৃত দর্শনের এবং সেই কাব্যসাহিত্যের রচয়িতাই লাভ করেন দার্শনিক-কবির মর্যাদা।
যাই হোক, দার্শনিক ও কবি পরস্পর বিচ্ছিন্ন নন, বরং একান্তই সগোত্র। কারণ উভয়েই ক্রান্তদর্শী ও সত্যদ্রষ্টা। এ অর্থের কবি কোলরিজ বলেছেন, ‘ঘড়সধহ ধিং বাবৎ ুবঃ ধ মৎবধঃ ঢ়ড়বঃ রিঃযড়ঁঃ নবরহম ধঃ ঃযব ংধসব ঃরসব ধ ঢ়ৎড়ভড়ঁহফ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যবৎ.’ অর্থাৎ একজন বড় মাপের দার্শনিক না হয়ে কেউ কখনো একজন শ্রেষ্ঠ কবি হতে পারেননি।
অন্তরের বিমূর্ত অনুভব ব্যাখ্যায় দার্শনিক ও কবি উভয়েই প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ অভিজ্ঞতার স্তর অতিক্রম করে এক উচ্চতর ভাবাবস্থায় (সড়ড়ফ) উপনীত হন এবং চলতি অভিজ্ঞতা, ভেদবুদ্ধি ও বোধিসমৃদ্ধ এক অখ- অপরোক্ষ সত্যদৃষ্টি লাভ করেন। এখানে দার্শনিকের সত্য ও কবির সুন্দর আর স্বতন্ত্র থাকে না, হয়ে যায় একাকার। সত্য ও সুন্দরের এই অখ- অনুভূতির ইঙ্গিত করেই অপর এক ইংরেজি কবি কিটস ঘোষণা করেছিলেন :
‘ইবধঁঃু রং ঃৎঁঃয, ঃৎঁঃয রং নবধঁঃু,Ñ ঃযধঃ রং ধষষ
ণব শহড়ি ড়হ বধৎঃয ধহফ ধষষ ুব হববফ ঃড় শহড়.ি’
অর্থাৎ, যা সুন্দর তা-ই সত্য, সত্যই সুন্দর-এটুকুই মানুষ জানে, এটুকু জানাই তার প্রয়োজন। এ অখ- অনুভূতির আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়েই আমাদের বাঙালি কবি বলেন :
অকূল শান্তি, সেথায় বিপুল বিরতি,
একটি ভক্ত করিছে নিত্য আরতি,
নাহি কাল দেশ, তুমি অনিমেষ মুরতি,
তুমি অচপল দামিনী।
দার্শনিক-কবির এ উচ্চতর একক অনুভূতির ব্যাপারটি নিতান্তই একটি নিজস্ব ব্যক্তিগত (ঢ়ৎরাধঃব) ব্যাপার। আর তাই কেউ কেউ এর প্রমাণিকতা ও জ্ঞানীয় বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এ ধরনের অনুভূতিকে নিতান্তই একটা অবাস্তব মন্ময় ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু আমার মতে, সমালোচকদের এ ধারণা যথার্থ নয়। কারণ প্রত্যক্ষণ ও অভিজ্ঞতামাত্রই কমবেশি মন্ময় প্রাইভেট ব্যাপার। কিন্তু প্রাইভেট বলেই যে তা অবাস্তব, এ দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। আমার অভিজ্ঞতা একান্তই আমার ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষণ, নিতান্তই আমার ব্যক্তিমনের ব্যাপার; কিন্তু তাই বলে কি এর সাথে বাস্তবতার মিল থাকতে পারে না? যেমন, আমি যে চশমা পরি সেই চশমার রঙ আমি যে দৃশ্য অবলোকন করি, সেই দৃশ্যে কিছুটা প্রভাব ফেলবেই; কিন্তু তার মানে এই নয়, এ চশমা দিয়ে আমি সূর্যের প্রকৃত রূপ ও রঙটাকে বদলে দিয়েছি।
আসল কথা হলো এই যে, উচ্চতর স্বাজ্ঞিক অনুভূতি (রহঃঁরঃরড়হ) সত্যিই বাস্তব কিনা, তা যাচাই করার এমন একটি স্বতন্ত্র পদ্ধতি থাকা চাই যার আবেদন থাকবে প্রচলিত ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা ও ভেদবুদ্ধির চেয়ে উচ্চমানের এক অখ- অনুভূতির প্রতি। আমার মতে, এ অনুভূতির যথার্থতা প্রমাণের একমাত্র উপায় অন্তর্দর্শন (রহঃৎড়ংঢ়বপঃরড়হ)। স্বাজ্ঞিক অনুভূতির ফলাফল যাচাই করার জন্য আমাদের অবলোকন করতে হবে নিজেদের প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাকে এবং সযতেœ আবিষ্কার করতে হবে অভিজ্ঞতার স্বরূপ ও নির্যাসকে। এ কথা ঠিক যে, উল্লিখিত উচ্চতর অনুভূতি মানুষের হয় না, কিন্তু যাদের হয় তাদের পক্ষে একে প্রতিপাদনের একমাত্র ফলপ্রদ উপায় অন্তর্দর্শন।
এখানে এ-ও মনে রাখতে হবে যে, উচ্চতর বোধি বা স্বজ্ঞার জন্য যে অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন তাকে প্রচলিত বুদ্ধি বা শিক্ষা-দীক্ষা থেকে পাওয়া যায় না। যেমন, কবি বাইরন (১৭৮৮-১৮২৪), দার্শনিক হিউম (১৭১১-১৭৭৬) প্রমুখ কোনো কোনো মনীষী সঙ্গীত অপছন্দ করতেন; কিন্তু তাই বলে সঙ্গীতরসের বাস্তবতা ও প্রোৎকর্ষ অসার হয়ে যায়নি। উচ্চতর স্বজ্ঞা বা অপরোক্ষ অনুভূতির বেলায়ও এ একই কথা প্রযোজ্য। কোনো কোনো প-িতব্যক্তি হয়তো স্বজ্ঞার বাস্তবতা খুঁজে পাননি; কিন্তু তাতেই যে সে স্বজ্ঞা অবাস্তব হয়ে যাবে, বিশ্লেষণী দার্শনিকদের এ দাবি যুক্তিসঙ্গত নয়।
সংস্কৃতি
সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ কালচার। ইংরেজি সাহিত্যে কালচার কথাটার প্রথম ব্যবহার করেন ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) ষোলো শতকের শেষভাগে। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের কাজ যেখানে প্রকৃতির প্রতি অনুগত থেকেই প্রকৃতিকে জয় করা, সেখানে কাব্য-সাহিত্য তথা কালচারের লক্ষ্য সুকুমার বৃত্তির অনুশীলন দ্বারা মানবমনকে প্রকৃতির যান্ত্রিক বন্ধন থেকে মুক্ত করা ও সৃজনশীল জীবনের সন্ধান দেয়া। কর্ষণ বা চাষবাসের (পঁষঃরাধঃরড়হ) মাধ্যমে একটা জমিকে যেভাবে ফসল উৎপাদনের উপযোগী করে তোলা হয়, তেমনি কৃষ্টি বা সাংস্কৃতিক কর্মধারার মাধ্যমে মানুষের অপরিশীলিত চিন্তা-ভাবনা ও আচার-আচরণকে পরিশীলিত করা হয়, মানুষের মনকে প্রেম-প্রীতি, সত্য-সুন্দর-কল্যাণের চর্চায় নিযুক্ত করা হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের (১৮৩৮-১৮৯৪) ভাষায় : ‘উদ্ভিদের পক্ষে কর্ষণ যাহা, মানুষের পক্ষে স্বীয় বৃত্তিগুলোর অনুশীলন তাহাই, এ জন্য ইংরেজিতে উভয়ের নাম পঁষঃঁৎব।’
বেকন থেকে শুরু করে ম্যাথ্যু অর্নল্ড, ইমারসন প্রমুখ পাশ্চাত্যে এবং বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) প্রমুখ বাংলা সাহিত্যে কৃষ্টি বা সংস্কৃতির সংজ্ঞার্থ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। তাদের মতামতের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য থাকলেও একটি বিষয়ে তারা সবাই ছিলেন একমত; আর তা হলো এই যে, সংস্কৃতিমাত্রই সর্বতোভাবে একটি অন্তর্লোকের ব্যাপারÑ সংস্কৃতি মানেই মানসিক অনুশীলন, সুরুচি ও শিষ্টাচারে, কিন্তু এর বহিঃপ্রকাশ ও ব্যাপ্তি ঘটে সঙ্গীতে কাব্যেসাহিত্যে ললিতকলায় ধর্মে ও দর্শনে। তা অবশ্য সংস্কৃতির সঙ্কুচিত অর্থ, আর সংস্কৃতিকে এ অর্থে ব্যবহারের অর্থই হলো একে নিছক চিন্তার, অনুভরের, জ্ঞানের তথা বিশুদ্ধ মননচর্চার ব্যাপার ভেবে ব্যবহারিক প্রয়োজন ও স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধেŸ স্থান দেয়া।
বলাবাহুল্য, এ মত পুরোপুরি ভাববাদী ও রোমান্টিকধর্মী। আর হালের বাস্তববাদী পরিবেশে তা প্রায় অচল। ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর অবস্থা ছিল আজকের দিনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত শান্ত ও নিরূপদ্রব এবং এ কারণেই হয়তো সেদিনের ভাবুক দার্শনিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা জগৎ ও জীবনকে দেখতেন ভিন্ন চোখে, ভাবালুতা রোমান্টিকতার রঙিন চশমায়। বাস্তবসত্তা যে আদর্শ জগৎ থেকে বহুদূরে এবং এর যে একটি রুদ্র ভয়াল রূপ আছে, তা তারা বড় একটা আমলেই নেননি, আর এ জন্যই তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদর্শায়িত করে ফেলতেন বাস্তবকে, সাধারণ বস্তুতে আরোপ করতেন সত্য সুন্দর ও কল্যাণের চিরঅম্লান আদর্শকে।
কিন্তু বিশ শতক পৃথিবীর মানুষের সামনে হাজির হলো বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার এবং নতুন বার্তা, মানবতার দুঃখ-বঞ্চনার এক মর্মান্তিক তালিকা নিয়ে। দেখতে দেখতে বিশ্বময় পরিবর্তন ঘটল মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার, বদলে গেল জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের চিন্তা এবং একই সঙ্গে সংস্কৃতি সম্পর্কে দীর্ঘদিনের ধারণাও গেল বদলে। এ সত্য তখন ক্রমেই পরিষ্কার হতে থাকে যে, সংস্কৃতির যেমন রয়েছে একটি অভ্যন্তরীণ মানসিক দিক, তেমনি আছে অপর একটি বাহ্য বাস্তব দিক। এতে যেমন রয়েছে মননচর্চা বা চিৎপ্রকর্ষের স্থান, তেমনি থাকা চাই বাস্তব জীবনবোধ ও বিষয়বুদ্ধির অবকাশ। এ পরিবর্তিত ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতি বলতে শুধু সঙ্গীত নৃত্যকলা কিংবা কাব্যচর্চাকে বোঝায় না, বোঝায় ধান-পাটের চাষ থেকে শুরু করে ভাস্কর্য, স্থাপত্যসহ সবরকম শ্রমসাধ্য ও বুদ্ধিদীপ্ত জীবনকর্মকে।
একথা সুবিদিত যে, চিন্তা ও ধারণাই কর্মের চালিকাশক্তি। চিন্তা দ্বারা উদ্বুদ্ধ না হলে কেউ কখনো কোনো কাজে প্রবৃত্ত হয় না, হতে পারে না। আর সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক চিন্তাপ্রণোদিত হয়ে একটি জনগোষ্ঠী যেসব মহৎ কর্ম সম্পন্ন করে সংস্কৃতি বলতে সেগুলোর সমষ্টিকেই বোঝায়। এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে সংস্কৃতির সঙ্গে দর্শনের সম্বন্ধ। সংস্কৃতির বেলায় যেমন, দর্শনের বেলায়ও তেমনি কোনো সহজ সংজ্ঞা নির্দেশ সম্ভব নয়। কিন্তু তবু দর্শন বলতে সাধারণত বোঝায় বিচারশীল বা যুক্তিপ্রসূত চিন্তাকে। আর সংস্কৃতি যদি সেই চিন্তার ফল বা চিন্তাপ্রণোদিত কর্মকা-ের সমষ্টি হয়ে থাকে, তা হলে সংস্কৃতির সঙ্গে দর্শনের যোগ আকস্মিক নয়, বরং একদম নিকট ও নিবিড়।
আসলে ইতিহাসের সেই ঊষালগ্ন থেকে দর্শন জগৎ ও জীবনের মৌল সমস্যাবলি সমাধানের যে প্রচেষ্টায় নিয়োজিত, যথার্থ সংস্কৃতি এ থেকে বিচ্ছিন্ন তো নয়ই, বরং তারই সার্থক পরিণতি। বস্তুত, যে কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশের পেছনে দর্শনের প্রেরণা ও প্রাণশক্তি কার্যকর। তা যদি না হতো তা হলে কোনো সংস্কৃতিই তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারত না, স্থায়ী মানবকল্যাণ বয়ে আনতেও সক্ষম হতো না। যেমন ধরা যাক আধুনিক ইউরোপীয় সংস্কৃতির কথা। এর মূলে যে আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন এবং সেই দর্শনের আন্তর্নিহিত বুদ্ধিবাদ কার্যকর ছিল, তা ইতিহাসের ছাত্রমাত্রেরই জানা। মধ্যযুগের ধর্মপ্রভাবিত পরিবেশে ব্যক্তির স্বাধীনচিন্তা ছিল অবরুদ্ধ এবং সমগ্র ইউরোপ নিমজ্জিত ছিল নির্বিচার বিশ্বাস ও কুসংস্কারের অতলে। কিন্তু স্বাধীনচিন্তার স্বাভাবিক স্রোতকে অনির্দিষ্টকাল দাবিয়ে রাখা যায় না, আর স্বাভাবিক কারণেই রেনেসাঁ যুগের ইউরোপ ব্যাকুল হয়ে ওঠে এ অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্য। দেখতে দেখতে দার্শনিকরা তৎপর হয়ে উঠলেন জগৎ ও জীবনকে স্বাধীনভাবে জানার প্রয়াসে, মানবতার স্বরূপ ও ইতিহাসকে নতুন করে আবিষ্কারের লক্ষ্যে। দর্শন সাহিত্য অর্থনীতি ভাস্কর্য শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয়ে তারা উন্মোচিত করলেন সৃষ্টিশীল চেতনা ও সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত, গড়ে তুললেন এক বর্ণাঢ্য ইউরোপীয় সংস্কৃতি।
এ সংস্কৃতির বিস্তার ও বিকাশের মূলে দার্শনিক চেতনা ও জীবনদৃষ্টি যে কীভাবে কার্যকর ছিল, তা আধুনিক ইতিহাসে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ। কর্তৃপক্ষের নির্বিচার ও নিঃশর্ত নির্দেশ উপেক্ষা করে সার্বভৌম বুদ্ধিকে জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানুসন্ধানের বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কত দার্শনিককে যে বেদনা ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে, কত যে আত্মবলিদান করতে হয়েছে, তা আজ কারো অজানা নয়। সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তি ছাড়া যে কোনো সংস্কৃতির যথার্থ বিকাশ ঘটে না, একথা আধুনিক ইউরোপীয় সংস্কৃতির বেলায় যেমন সত্য, তেমনি সত্য অন্য সব সংস্কৃতির বেলায়।
সংস্কৃতির সঙ্গে দর্শনের সম্বন্ধ নিয়ে যেমন, ধর্মের সম্বন্ধ নিয়েও তেমনি প্রশ্ন ওঠে। কেউ কেউ এমন কথাও বলতে চান যে, এ দুটি বিষয় আসলে এক। কিন্তু তাদের এ ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়, বিশেষত এ জন্য যে, ধর্ম (বিশেষত প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম) প্রধানত একটি বিশ্বাসের ব্যাপার। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানমাত্রই বিশ্বাসকেন্দ্রিক ও অনুভূতিনির্ভর। ধর্মের অনুসারীকে কিছু দৈব নির্দেশ সরল বিশ্বাসে মেনে নিতে হয় এবং তার কর্ম ও আচরণকে পরিচালিত করতে হয় ধর্মীয় বিধি-নিষেধের আলোকে। অন্যদিকে সংস্কৃতি বলতে আমরা প্রত্যাদিষ্ট বা পূর্বনির্দিষ্ট কিছুকে বুঝি না, সংস্কৃতি নিছক কোনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার নয়। সংস্কৃতির পরিসর আরো ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। সংস্কৃতি ধর্ম থেকে প্রেরণালাভ করতে পারে বটে, কিন্তু এর পরিপূর্ণ বিকাশ ধর্মের আইন-অনুশাসন ও যাগযজ্ঞকে ছাড়িয়ে যায়। সংস্কৃতির স্রোত প্রবাহিত হয় বিভিন্ন খাতে এবং এর বিকাশ ঘটে একটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘকালের বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক নৈতিক রাজনৈতিক নান্দনিক প্রভৃতি বিভিন্ন কর্মকা-।
তবে এ সবকিছুর পরও মানতে হবে যে, ধর্ম ও সংস্কৃতি উভয়েরই লক্ষ্য জীবন। আর একই জীবনকে কেন্দ্র করেই যেহেতু উভয়ের উদ্বোধন এবং একই জীবনের লক্ষ্যেই যেহেতু উভয়ের গতিবিধি, সে কারণেই তারা পারস্পরবিচ্ছিন্ন নয়, বরং নিকট ও নিবিড় সম্বন্ধে আবদ্ধ।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ধর্ম সংস্কৃতির ওপর বিস্তার করে সুনিশ্চিত প্রভাব, গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করে সংস্কৃতির বিকাশের পথে। সংস্কৃতিও ধর্মকে সাহায্য করে নানাভাবে। সাংস্কৃতিক কর্মকা- ব্যতিরেকে ধর্ম হারিয়ে ফেলে তার বৈচিত্র্য ও গুরুত্ব, পরিণত হয়ে যায় নিছক একটি প্রাণহীন বিমূর্ত বিষয়ে।