ঢাকা ওয়াসা উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও বাস্তবে তা সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণে আসেনি। বরং বড় বড় প্রকল্পের নামে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বিগত ১১ বছরে ওয়াসা ৪০টির বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু কোন প্রকল্পই এখনো জনগণের কল্যাণে আসেনি। বরং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই টাকা তুলে নিয়ে গেছে। আর ধীর গতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সময় ও টাকার অঙ্ক বাড়ানো হয়েছে। প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে এখনো অনেক কাজ চলমান রয়েছে। ঢাকা ওয়াসা ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে গত ১১ বছরে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে ১১ বার পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রতি হাজার লিটার পানির দাম পৌনে ৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করা হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ব্যাপক দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণেবা ওয়াসার এমন পরিণতি। বিভিন্ন সময় ওয়াসার এই অবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও কোন ফল হয়নি। উল্টো অনেকেই এমডির রোষানলে পড়ে চাকরি হারিয়েছে। ওয়াসা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঢাকায় প্রতিবছর জনসংখ্যা গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে গভীর নলকূপের উৎপাদন গড়ে ৫ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। অনুমান করা হচ্ছে আগামী ২০২৩ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর জনগণের জীবনযাত্রার মান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার দ্রুত উন্নতিতে মাথাপিছু পরিমাণগত পানি ব্যবহার বাড়ছে। একইসঙ্গে ঢাকা শহরের আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় জনসংখ্যাও বাড়ছে। ফলে বাড়ছে পানির চাহিদাও। এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালে পানির চাহিদা বেড়ে ৩৫০০ এমএলডি হবে।
সূত্র জানায়, বিগত ১১ বছরে ৪০টির বেশি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। তার মধ্যে রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা-যশোলদিয়া পানি শোধনাগার, সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার, প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার, সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার, সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে তেঁতুলঝোড়া-ভাকুর্তা থেকে ঢাকায় পানি আনা, সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট। তবে সংস্থাটির প্রতিটি প্রকল্পের পিডি নিয়ে চরম বিতর্ক রয়েছে। ইতিমধ্যে একাধিক পিডিকে দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরো কয়েকজন দুর্নীতিবাজ ইঞ্জিনিয়ারকে দুদক চিঠি দিয়েছে। তাছাড়া এক থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে আরো প্রায় ৩ ডজন প্রকল্প তৈরি করা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, পদ্মা-যশোলদিয়া এবং সাভারের ভাকুর্তা-তেঁতুলঝোড়া পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসাকে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। এমনকি প্রকল্প দুটির যাবতীয় বিলও তুলে নিয়েছে ঠিকাদার। যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, কাজ শেষ হওয়ার অসত্য তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্প দুটি উদ্বোধনও করানো হয়েছে। অথচ নিম্নমানের কাজ এবং পুরো কাজ শেষ না করেই পদ্মার মাওয়া পয়েন্ট থেকে রাজধানীতে পানি সরবরাহের পদ্মা-যশোলদিয়া প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে ঢাকা ওয়াসা। এ প্রকল্পের ব্যয় শুরুতে ৩ হাজার ৫০৮ কোটি ৭৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা থাকলেও পরে তা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারকে সুবিধা দিতেই পুরো বিল দিয়ে দেয়া হয়েছে। পদ্মা-যশোলদিয়া পানি শোধনাগারের মাধ্যমে রাজধানীবাসীর পানির সঙ্কট মেটাতে ৭ বছর আগে হাতে নেয়া ওই প্রকল্পের লক্ষ্য প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার সুপেয় পানি সরবরাহ। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ৭ বছর সময় লেগে যায়। কিন্তু ঢাকাবাসীর জন্য নেয়া এ প্রকল্প তাদের ঘরে পানি পৌঁছে দিতে এখন পর্যন্ত সরবরাহ লাইনই তৈরি হয়নি। ফলে পানির সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। পুরনো লাইনেই পানি সরবরাহ চলছে । দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার করে যেখানে মাসে ১ হাজার ৩৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহের কথা, সেখানে ঢাকাবাসী পানি পাচ্ছে মাসে ৪৬০ কোটি লিটারের মতো। তাতেত বছরে প্রকল্পে ক্ষতি হচ্ছে ২শ’ কোটি টাকার বেশি।
এদিকে পদ্ম-যশোলদিয়ায় পরিকল্পনা অনুযায়ী মাওয়া থেকে ঢাকায় পানি সরবরাহের জন্য খাল-নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপলাইন স্থাপনের কথা থাকলেও কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে তা করা হয়েছে। তাতে নদীর তলদেশের পাইপের নিরাপত্তার জন্য কোন নিরাপত্তা খাঁচা (প্রটেকশন কেজ) দেয়া হয়নি। কয়েক মাস আগে ধলেশ্বরী নদীতে চলাচলকারী একটি নৌযানের তলা ওই পাইপে লাগে। তাছাড়া ওই প্রকল্পে নির্ধারিত পাইপের বদলে কম পুরুত্বের পাইপ বসানো হয়েছে। ২২ মিলিমিটার পুরুত্বের (কে-১০) পরিবর্তে দেয়া হয়েছে ১৯ মিলিমিটার (কে-৯)। ফলে প্রকল্পের ৩৩ কিলোমিটার পাইপলাইনই নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে।
অন্যদিকে পানির খনি পাওয়ার কথা বলে ২০১২ সালের জুন মাসে সাভারের তেঁতুলঝোড়া ও ভাকুর্তা এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য ভাকুর্তা-তেঁতুলঝোড়া ওয়েলফিল্ড প্রকল্প হাতে নেয় ওয়াসা। বলা হয়েছিল হিমালয় থেকে একটি চ্যানেল এখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। যা একশ’ বছরেও শেষ হবে না। তাই এখান থেকে ঢাকা শহরে পানি আনতে ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় ৪৬টি পাম্প, পাম্পের পানি শোধনে দুটি আয়রন অপসারণ প্লান্ট, একটি ভূ-উপরিস্থ জলাধার, একটি অফিস ভবন এবং ৪২ কিলোমিটার পানি সরবরাহ লাইন স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেখান থেকে উত্তোলিত পানি মিরপুর এলাকায় সরবরাহ করার কথা ছিল। সেখান থেকে প্রতিদিন পাওয়া যাবে ১৫ কোটি লিটার পানি। ২০১৬ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ওয়াসা তা পারেনি। দুই দফা সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু কয়েকটি পাম্প চালুর পরই আশপাশের সাধারণ টিউবওয়েলগুলোতে পানি তোলা বন্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় ১৫টি পাম্প চালু করে প্রকল্পের কাজ শেষ করে ঢাকা ওয়াসা। গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রকল্পটি ওয়াসাকে বুঝিয়ে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজের মধ্যে বিল নেয়ার পাশাপাশি প্রকল্প বুঝিয়ে দেয়ার পর বাকি বিলও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ওয়াসা থেকে তুলে নেয়। কিন্তু এখনো ৭টি নলকূপ পাইলিংয়ের পর পড়ে আছে। একেকটির পাইলিংয়ে খরচ হয়েছে ৭০ লাখ টাকা। বাকি ১৫টি নলকূপ চালু করা হয়েছে। অন্যগুলোর অবকাঠামো তৈরির পর সেগুলো বন্ধ আছে। প্রকল্পে বেশি দামে নিম্নমানের পাইপ কেনার প্রতিবাদ করায় আগের প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া সরবরাহ লাইন না করেই ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের উদাহরণ শুধু পদ্মা-যশোলদিয়াই নয়। সরবরাহ লাইন নিয়ে কোন অগ্রগতি না থাকার পরও এগিয়ে চলেছে মেঘনা গর্ন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প ও দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের কাজ। ওই প্রকল্পের কোনটিরই সরবরাহ লাইন স্থাপন না করে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে।
নগরপরিকল্পনাবিদদের মতে, জলাভূমি, খাল বিল আর নদী পরিবেষ্টিত এক অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশে ঢাকার যাত্রা শুরু। ওই ঢাকাকে পরিকল্পনার অভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্যার পেট্রিক গেডেস ঢাকা শহরের পরিকল্পনায় জলাশয়, খাল বিল আর নদী নালার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি ঢাকার এই জলাভূমিকে শহরের পানি নিষ্কাশন, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং চিত্তবিনোদনের প্রয়োজনে নগরের ভূমি বিন্যাসে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো উদাসীনতার কারণে আজ ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখন সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকা বসবাসের উপযুক্ততা হারাবে। ঢাকার আমাদের চারপাশে নদী থাকায় ঢাকা ওয়াসা নদী থেকে পানি নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অসহায় জনগণকে প্রতারিত করা হয়েছে। বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তাতে ওয়াসা ও জনগণের কোন কল্যাণ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানান, ওয়াসার অনেক বিষয়ে অসঙ্গতি রয়েছে। ওয়াসার বেশ কয়েকটি প্রকল্প ও খাল পরিদর্শন করে যা দেখা গেছে তাতে সন্তুষ্ট হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ওয়াসাকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ওয়াসার যে কোন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।