লালমনিরহাটে থেমে থেমে কয়েক দফায় বন্যার পর তিস্তা বিধৌত চরাঞ্চলের প্রায় ৩ হাজার পরিবার নদী ভাঙ্গনের কারণে বাস্তুহারা হয়ে পড়েছে। তিস্তার অব্যাহত ভাঙ্গনে ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বসত-ভিটা হারিয়ে তাদের কেউ আশ্রয় নিয়েছে তিস্তার বাঁধে আবার কেউ স্কুল-কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। প্রতি বছর বন্যায় সৃষ্ট এসব সমস্যা ও দুর্ভোগ লাঘবে স্থায়ী সমাধান চান তিস্তা চরাঞ্চলের অসহায় নিঃস্ব পরিবারের মানুষ গুলো।
রোববার (১৬ আগষ্ট) সরেজমিনে ভাঙ্গন কবলিত এলাকা ঘুরে নদী গর্ভে বিলিন হওয়া মানুষদের কষ্টের কথা জানান তিস্তা পাড়ের মানুষ গুলো।
নদী ভাঙন রোধে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিকল্পিত নদী শাসনের দাবি করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আর নদী পাড়ের মানুষরা বলছেন, শুধু বন্যা বা বর্ষা মৌসুমে নয়, সারাবছরই নদী ভাঙন রোধে গুরুত্বারোপ করা উচিত। অন্যদিকে এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিস্থিতির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভাঙন রক্ষায় বড় প্রকল্প গ্রহণে পরিকল্পনার কথাও ভাবছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড।
লালমনিরহাট, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তায় পানি কমলেও সব জায়গায় একরকম নয়। কোথাও পানি কমলে আবার অন্য কোথাও বাড়ছে। তিস্তার পানি বাড়া-কমাতেই থেমে নেই। সৃষ্ট এই বন্যার কারনেই অসংখ্য মানুষের ঘর-বাড়ি, ঠিকানা কেড়ে নিয়েও শান্ত হয়নি খরস্রোতা এই তিস্তা নদী। এখন শুরু হয়েছে নদী ভাঙ্গন। বর্তমানে তাই তিস্তা পাড়ের মানুষদের আরেক আতঙ্কের নাম নদী ভাঙ্গন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়নের খবির মওলা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'হামার (আমাদের) কপাল পোড়া বাহে (বাবা)। কায়ো হামার কতা (কেউ আমাদের কথা) শোনে না। ঘরোত (ঘরে) আগুন নাগলে, তাক নিবিয়া (সেটা নিভিয়ে) নতুন করি (করে) বাড়ি বানা (বানানো) যায়। কিন্তুক নদী যদি একবার ঘর-বাড়ি সোগ (সব) কিছু নিয়্যা যায়, তাইলে (তাহলে) হামার (আমাদের) ভাগ্যোত (ভাগ্যে) আর কি থাকে? একটা বাঁধ হইলে হামার এত বড় ক্ষতি হইল না হয় (হইতো)।
একই গ্রামের আবদুল জব্বার, রাজু আহমেদ, মমিনুল ইসলাম ও সোলায়মান আলী জানান, 'নদী ভাঙন এলাকার মানুষের মতো অসহায় মানুষ আর কোথাও নেই। দিনরাত মনের ভিতরে শুধু ভয় কাজ করে কখন নদী হানা দেয়। অনেক সময় হাজারো চেষ্টা করেও ঘর-বাড়ি বাঁচানো সম্ভব হয় না। যাদের একেবারে জায়গা নেই, তাদের কষ্ট তো সীমাহীন।'
সাম্প্রতিক দীর্ঘস্থায়ী এই বন্যায় লালমনিরহাটে তিস্তা সংলগ্ন চরাঞ্চলে নদী ভাঙনে ভিটে বাড়ি হারিয়েছে প্রায় তিন হাজার মানুষ। ঘরবাড়ি হারানোর পাশাপাশি ফসলি জমি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি হওয়াতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
এদিকে পানি যতই কমছে ততই তীব্র হচ্ছে নদীর ভাঙন। বিলীন হয়েছে বেড়িবাঁধ, সহস্রাধিক মানুষের ঘরবাড়ি-জমি। অথচ তিন বছর আগে থেকে এই সমস্যার জানান দিলেও অস্থায়ী প্রতিরোধের চেষ্টাতেই সীমাবদ্ধ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দৌড়ঝাঁপ।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন মোফা বলেন, এবার বন্যায় এই ইউনিয়নের চর চাংড়া গ্রাম বিলীনসহ মসজিদ, মাদ্রাসা, সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালর্ভাটের অভাবানিয় ক্ষতি হয়েছে। অবিলম্বে বামতীরে বাঁধ নির্মাণসহ তিস্তা নদী খনন করা না হলে নদী যেদিক পাবে সেদিক প্রবাহিত হবে। ফলে তিস্তা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করছি। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যা দূরীকরণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবে। এ ছাড়া এখন বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের প্রত্যেক ডিভিশনে বস্তা আছে। তাৎক্ষণিক ভাঙন রোধের জন্য এ জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে।
এদিকে তিস্তার ভাঙন রোধ ও স্থায়ী চরগুলো রক্ষায় নদীর দুই ধারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কথা জানালেন এই প্রধান প্রকৌশলী। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এটি বাস্তবায়নে আরও দেরী হবে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে গৃহহীন হয়ে পড়ছে লক্ষাধিক পরিবার। একই সাথে তিস্তার বামতীরে বাঁধ নির্মাণ করা না গেলে তিস্তা নদীর মূল প্রবাহকে ঘিরে গড়ে ওঠা ডান তীর বাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর রক্ষা বাঁধ, বেড়িবাঁধসহ হাজার হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো অকার্যকর হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।