শিক্ষা মন্ত্রণালয় রহস্যজনকভাবে আইন লঙ্ঘনকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি উদাসীনতা দেখাচ্ছে। বারবার আলটিমেটাম দেয়ার পরও স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। অথচ শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ ওসব প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি হিসেবে পৌনে ৩ বছর আগে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি বন্ধ করে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজও ওই উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত ওই সংক্রান্ত কোনো বৈঠকও ডাকা হচ্ছে না। বরং ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ ও অনুষদ খোলার অনুমোদন বন্ধ এবং সমাবর্তন আয়োজনের অনুমতি স্থগিত রাখার অবস্থান থেকেও সরে আসা হয়েছে। বিগত ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৪১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সাময়িক সনদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। অথচ এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাসে ওসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকার দেশে ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিগত ১৯৯২ সাল থেকে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ শুরু হয়। আর ২০১০ সালের আগের আইনে ৫২টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওসব বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০১০ সাল থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে কয়েকদফা আলটিমেটাম বেঁধে দেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সর্বশেষ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দিয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এ নির্দেশ পালন করতে পারবে না সেগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেয়া হবে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্থায়ী ক্যাম্পাসে পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু না করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ থাকার কথা। আলটিমেটাম প্রতিপালনে ব্যর্থতার দায়ে তার আগে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ ও অনুষদ অনুমোদন এবং সমাবর্তন আয়োজনের অনুমতি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে রহস্যজনক কারণে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজে (বিওটি) বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা জড়িত রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে। ওই কারণে ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিব্রত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ওসব বিশ্ববিদ্যালয়কে আইনের আওতায় আনতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি বলে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বর্তমানে ৫২টির মধ্যে মাত্র ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেছে। তাছাড়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেছে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি। আর ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আলটিমেটাম লঙ্ঘন করছে। ফলে বিগত ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার কথা ছিল। তাছাড়া ২০১২-২০১৩ সালে ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে ১৬টির বয়স ৭ বছর পার হয়েছে। ১৬টির মধ্যে কেবল নটরডেম, বিজিএমইএ এবং হামদর্দ ইউনিভার্সিটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাকি ১০টির মধ্যেও দু’একটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০০০ সালের ২১ মার্চ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অনুমোদন পায়। সেটি বনানী ও গ্রিন রোডে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে এবং বাড্ডায় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করছে। ১৯৯৬ সালের ১৬ মে দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ অনুমোদন পায়। প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরেও প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। ২০০১ সালের ১৩ মার্চ অনুমোদন পায় মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। সেটি বিরুলিয়ায় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের কথা বললেও ঢাকায় একাধিক স্থানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্বর ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ অনুমোদন পায়। কিন্তু পস্খতিষ্ঠানটি এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করেনি। এ ব্যাপারে গত সেপ্টেম্বরে ইউজিসি প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের ডেকেছিল। কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।
এদিকে প্রাইম ইউনিভার্সিটি মিরপুরে স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়লেও সেখানে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জমি নেই। তাছাড়া স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়া কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অন্যত্র কার্যক্রম পরিচালনারও অভিযোগ রয়েছে। ২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অনুমোদন পায়। বিশ্ববিদ্যালয়টি আশুলিয়ায় নিজস্ব ক্যাম্পাস নির্মাণ করলেও সেখানে পুরোপুরি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে না। বরং রাজধানীর শুক্রাবাদে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক ক্যাম্পাস রয়েছে। চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্ব^র অনুমোদন পায় এবং চট্টগ্রাম শহরে একাধিক ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব অবস্থার কথা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বারবার অবহিত করে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
অন্যদিকে ইউজিসি সংশ্লিষ্টদের মতে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করেছে। যেগুলো যেতে পারেনি সেগুলোর ব্যাপারে কমিটি কাজ করছে। নতুন করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম মূল্যায়নে আরেকটি কমিটি করা হবে। তবে পুরনো ৫২টির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কয়েকটি এখন পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জায়গাজমিই কেনেনি। আর কিছু প্রতিষ্ঠান আংশিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের সর্বশেষ বেঁধে দেয়া সময়ের পর সেগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ থাকার কথা ছিল। আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠার ৭ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে হয়। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার বয়স ৭ বছর হয়েছে সেগুলোর প্রতিষ্ঠাকালীন শর্তগুলো বিদ্যমান থাকলে এবং ক্যাম্পাস নির্মাণ কার্যক্রমের অগ্রগতি সন্তোষজনক থাকলে আবেদনের ভিত্তিতে সাময়িক সনদের মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়ানোর নির্দেশনা আইনে আছে। ওই ধরনের ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩টির স্থায়ী ক্যাম্পাস আছে। ৭টি সাময়িক সনদের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে। এখন পরিদর্শন করে পরবর্তী সিদ্ধান্তের সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপরি স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেছে আর কিছু আংশিক গেছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া ও ক্যাম্পাস নির্মাণের কোনো উদ্যোগ না নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।