কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামত এবং স্লিপের বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগই শেষ হয়ে যাচ্ছে ঘুষ দিতে। ঘুষের এসব টাকা যাচ্ছে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা-কর্মচারী, উপজেলা প্রকৌশলী ও শিক্ষক নেতার পকেটে। আর এসব টাকা ভাগ-বাটোয়ারার দ্বায়িত্বে খোদ উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। ঘুষের বিলি বন্টন শেষে নামমাত্র কাজ দেখিয়ে বাকী টাকা প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির পকেটস্থ হচ্ছে। ফলে সরকারের বরাদ্দের টাকা বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন না হলেও সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যাক্তিদের উন্নয়ন হচ্ছে। অনিয়ম রোধে আগস্ট হতে মে মাস পর্যন্ত বরাদ্দ দেবার দাবী অভিভাবক মহলের।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৯-২০২০অর্থবছরে ক্ষুদ্র মেরামতের রাজস্ব খাতের উপজেলায় ৭০টি বিদ্যালয়ের জন্য ০১লাখ ৫০হাজার করে মোট ০১ কোটি ৫লাখ টাকা। পিডিপি-৪ এর অধিনে ৫৬টি বিদ্যালয়ে ২লাখ করে মোট ১ কোটি ১২লাখ টাকা। এছাড়াও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বরাদ্দের ফেরত আসা রাজস্ব খাতের ৩৯টি বিদ্যালয়ের ১লাখ ৫০হাজার করে মোট ৫৮লাখ ৫০হাজার টাকা। এবং পিডিপি-৪ এর আওতায় ৪২টি বিদ্যালয়ের জন্য ২লাখ করে মোট ৮৪লাখ টাকা। এছাড়াও ২০১৯-২০২০অর্থ বছরের স্লিপের টাকা ১৩৫টি বিদ্যালয়ে ৪০হাজার মোট ৫৪লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। এ কয়েক ধাপের বরাদ্দের টাকা মোট ৪ কোটি ১৩লাখ ৫০হাজার টাকা। উপজেলার একাধিক বিদ্যালয়ে দুই থেকে তিনটি করে প্রকল্পের টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ৩০জুনের মধ্যে বিদ্যালয়ের উন্নয়নের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কোথাও কাজ করা হয়নি। অথচ কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে বিল ভাউচার জমা দিয়ে টাকা তুলে নেবার অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিনে উপজেলার কেদার, কচাকাটা, বল্লভেরখাষ, রায়গঞ্জ, নারায়নপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় দীর্ঘদিন থেকে তালা ঝুলছে। করোনার সময়কাল থেকে এসব বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। ময়লা আর আবর্জনার ভাগারে পরিনত হয়েছে বিদ্যালয়গুলো। চলতি বছরে এসব বিদ্যালয়ে কোন প্রকার উন্নয়ন কাজ হয়নি বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের। কেদার ইউনিয়নের শোভারকুটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার সবুর মিয়া, শাহালম, কাটাজেলাস সরকারি বিদ্যালয় এলাকার আবু হানিফ, বিঞ্চুপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার আবদুল বাতেন, প্রভাষক আজাদ হোসেন, ভাটিকেদার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার নূরন্নবী মিয়া জানান, বিগত দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়গুলোতে কোন উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি। তাদের অভিযোগ এর আগে উন্নয়নের নামে যা এসেছে প্রধান শিক্ষক ও কমিটির লোকজনসহ সংশ্লিষ্টরা ভাগবাটোয়ারা করে নিজ পকেটে ভরছেন। তারা আরও বলেন, বরাদ্দ কখন আসে কীভাবে খরচ হয় অভিভাবকসহ কমিটির সদস্যরা জানে না। তাই সরকারের পক্ষ একটি ইষ্টিমেট তৈরি করে, বরাদ্দ পাওয়া বিদ্যালয়ের নাম সমূহ শিক্ষা অফিসে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এছাড়াও প্রতিবছর জুন ক্লোজিংয়ের সময় বর্ষা, বন্যা থাকায় বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করতে সুবিধা হয় সংশ্লিষ্টদের। তাই এই বরাদ্দ বছরের আগস্ট হতে পরের বছরের মে মাস পর্যন্ত ব্যয় নির্ধারণ করলে প্রকল্পের টাকা সঠিকভাবে ব্যয় হতো বলে তারা অভিমত দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের বরাদ্দে সমস্ত টাকা ৩০ জুনের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ দেখিয়ে ভাউচার দিয়ে ট্রেজারী থেকে তুলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তার অফিসের ব্যাংক এ্যকাউন্টে জমা রেখে প্রধান শিক্ষকদের সাথে চলছে ঘুষের দেন দরবার। যাদের সাথে দেন দরবারে বনছে তাদের টাকা এক এক করে ছাড় দিচ্ছেন। এই দেন দরবারে উঠে এসেছে ঘুষের বিবরণ। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রশাসন, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশলী, শিক্ষক নেতাসহ অনেক ধাপে ভাগবাটোয়ারা হয় এই টাকা। খোদ শিক্ষা অফিস থেকে বলা হয়েছে বরাদ্দের অর্ধেক টাকার কাজ করে বাকি টাকা ঘুষ দিতে হবে ঘাটে ঘাটে।
এ বিষয়ে শোভারকুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খোরশেদ আলম বলেন, বিল-ভাউচার সব তৈরি হয়েছে দেন দরবার চলছে। বরাদ্দের ফিফটি পার্সেন্ট টাকা বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে যাবে। তবে চাকুরি আর হয়রানির ভয়ে সব কিছু খুলে বলেননি তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একজন প্রধান শিক্ষক বলেন, প্রত্যয়ন নিতে উপজেলা প্রকৌশলীর নামে ৭হাজার, ইষ্টিমেট প্রস্তুতের নামে ৩হাজার, বিলভাউচার তৈরীর নামে ২হাজার, উপজেলা পরিষদের নামে ২০হাজার টাকা নিচ্ছেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ইছাহাক আলী। তিনি আরোও জানান, এ ছাড়া শতকরা ১৫ভাগ টাকা ঘুষ দিতে হয় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অফিসে।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ইছাহাক আলী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি তো বিল প্রদানে স্বাক্ষর করি না। তবে আমার দিয়ে কে বা কারা করছে আমার জানা নেই।
উপজেলা প্রকৌশলী বাদশা আলমগীর বলেন, বিদ্যালয়গুলোতে সরেজমিন কাজ দেখে প্রত্যয়ন দেয়া হয়। উৎকোচ নেবার বিষয়ে নিজের সাফাই গেয়ে বললেন বিষয়টি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
এই বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার অধিকারীর কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ অফিস না এসেই লালমনিরহাটে নিজ বাড়িতে বসে অফিস করছেন। ফোনেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর আহমেদ মাছুম জানান, অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে শিক্ষাকর্মর্তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে বরাদ্ধের টাকা উত্তোলন করে রেখেছেন। বিদ্যালয়গুলোর কাজ করার পর এসব টাকা দেয়া হবে। তিনি আরোও বলেন বরাদ্দের অর্ধেক টাকা ঘুষ এবং ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপারে কিছইু জানেন না, কেউ অভিযোগ দিলে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।