নারায়ণগঞ্জের মসজিদের এসি বিস্ফোরণে নিহত শুকুর আলী নয়ন (২৬) এর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নয়নের মৃত্যুর পর বর্তমানে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে পুরো গ্রামটি।
বুধবার ( ৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে নয়নের বাড়িতে গেলে জানাযায় বাবা ভুমিহীন দিনমজুর মেহের আলীর সংসারে আলো জ্বালানোর সন্তান ছিলেন নয়ন।
এর আগে শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধিন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
নিহত শুকর আলী নয়ন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তালুক পলাশী কৈটারী গ্রামের ভুমিহীন দিনমজুর মেহের আলীর বড় ছেলে।
নিহতের পরিবার ও গ্রামবাসী জানান, ভুমিহীন দিনমজুর মেহের আলীর তিন ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর মৃত খতিবুদ্দিনের বাড়িতে ঘরজামাই থাকতেন। বাবার অভাবের সংসারে হাল ধরতে ১৩ বছর আগে ৫ম শ্রেণি পাশ করে ঢাকায় পাড়ি জমায় শুকর আলী নয়ন।
সেই থেকে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে নয়ন। সে খানকার আয়ে একমাত্র বোনের বিয়ে এবং ছোট দুই ভাইকে হাফেজিয়া মাদরাসায় পড়ানোসহ সংসারের যাবতীয় খরচ চালাতেন নয়ন। এ ভাবে নয়নের আলোয় আলোকিত হতে শুরু করে ভুমিহীন মেহের আলীর সংসার।
ভুমিহীনের খাতা থেকে বাবার নাম কেটে দিতে সাম্প্রতি সময় ১৪ শতাংশ জমি ক্রয় করে একটি মাত্র টিনের ঘর তুলে বাবা মায়ের বসবাসের ব্যবস্থা করেন নয়ন। সেই জমির পুরো টাকা পরিশোধ না হওয়ায় তা রেজিস্ট্রি করে নিতে পারেননি তিনি।
কথা ছিলো ধিরে ধিরে টাকা পরিশোধ হলে জমি রেজিস্ট্রি করে দিবেন জমির মালিক খালাত ভাই ওবায়দুল। কিন্তু সেই টাকা পরিশোধ না হতেই মেহের আলীর সংসারের আলো জ্বালানো প্রদীপটি চিরতরে নিভে গেছে।
শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদের এয়ার কন্ডিশনার (এসি) বিস্ফোরণের ৩৭ জন দগ্ধ হন। সেখানে দগ্ধ হয়ে ঢাকা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন পোশাক শ্রমিক শুকর আলী নয়ন। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। অবশেষে হেরে না ফেরার দেশে চলে যান নয়ন।
শনিবার দুপুরে নয়নের মৃত্যুর খবর লালমনিরহাটে তার গ্রামে পৌছলে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো কৈটারী গ্রাম। প্রিয় সন্তানের দগ্ধ নিথর দেহ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন বৃদ্ধ বাবা মেহের আলী, গ্রামবাসী ও আত্মীয়-স্বজন। সংসারের প্রদীপকে হারানোর শোক মুর্ছা ফেলতে পারছে না বাবা মেহের আলী। দিনরাত অঝরে কেঁদেই চলেছেন নয়নের বাবা।
গ্রামবাসী ও স্বজনরাও তাকে সান্তনা দেয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের আহাজারীতে পুরো গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। প্রতিক্ষা শেষে যখন নয়নের নিথর দেহ তার গ্রামের বাড়িতে এসে পৌছায় তখন হাজার হাজার মানুষ নয়নের মরদেহ এক পলক দেখার জন্য ভির করতে থাকেন। এক পর্য়ায়ে মরদেহ গ্রামে পৌছুলে পুরো গ্রামের মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়। সবাই যেন কান্না করতে ভুলেই যায়। পরদিন সকালে পলাশী বাজার কেন্দ্রীয় কবর স্থানে তাকে দাফন করা হয়।
নয়নের গ্রামের বন্ধু জয়নাল আবেদীন জানান, বোনের বিয়ে দেয়ার পরে বাড়ি করার জমি ক্রয় করে নয়ন। সেই জমির টাকা পরিশোধ করে রেজিস্ট্রি করে নিয়ে নিজে বিয়ে করতেন নয়ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন তার পুরন হয়নি। গ্রামের সকলের প্রিয় ছিল নয়ন।
নয়নের মামি শরিফা বেগম জানান, বাবার অন্ধ সংসারটির হাল ধরে আলোকিত করে তোলে নয়ন। বোনের বিয়ে ছোট ভাইদের লেখাপাড়া ও সংসার খরচ সবই ছিল নয়নের টাকায়। এখন এ সংসার কিভাবে চলবে?
নয়নের বাবা মেহের আলী কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, নামাজে যাওয়ার আগেও মোবাইলে বাড়ির খবর নিয়েছিল তার চোখের মনি নয়ন। বলেছিল “বাবা এখন নামাজে যাচ্ছি। নামাজ শেষে বাসায় গিয়ে ঘুমাবো। আজ আর কথা হবে না। কাল সকালে কথা হবে। এ কথা বলারর পর পরই তার আর কোন কথা বলতে পারেননি মেহের আলী এ সময় তিনি সঙ্গাহীন হয়ে পড়েন।
পলাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি শুকুর আলী নয়নকে খুব ভাল ভাবে চিনেন। ভদ্র, নম্র ও পরিশ্রমি এই ছেলেটি অল্প বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে কেউ কল্পনা করতে পারেননি। সে ছিল তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। তার অকাল মৃত্যুতে ওই পরিবারটি হতাশায় পড়ে গেছেন।