বেশভূশায় নারীর বেশ, সাজস্বজ্জায়ও নারীর চেয়ে কোন অংশে যেনো কোন কমতি নেই, এমন মনে না হলেও তিনি নারী বা পুরুষ কোনটিই নন। তিনি বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত তৃতীয় লিঙ্গ যাদের আমরা সাধারণত হিজড়া বলে থাকি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) হলেও আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর কখনো পারিবারিক কখনো সমাজের অবহেলা আর অমানবিক আচরণে এক সময় সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিজ নিজ জাত গোষ্ঠী ভুলে গিয়ে যোগ দেন (তৃতীয় লিঙ্গ) হিজড়া দলের সাথে। শুরু হয় সমাজ জীবন থেকে তাড়া খাওয়া এক হিজড়া জীবন। পদে পদে বাধা-বিপত্তিসহ বঞ্চনাময় জীবন অতিবাহিত করার জীবন যুদ্ধ। যে যুদ্ধটা তাদের শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ যখন তাদের বয়স ১১/১২ বছর তখন থেকেই পরিবর্তন হতে থাকে তাদের শারীরিক ও মানসিকতার। আর সেই শুরুর যুদ্ধ থেকেই জীবনের শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে হয় একাই।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে হিজড়াদের উপর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, হিজড়া জীবনের সবচেয়ে বঞ্চনাকর বিষয় হচ্ছে তাদের পুরুষ-মহিলার ঊর্ধ্বে একটি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দান করা যা তাদের বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসেবে সম্ভাবনাময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনে বাঁধা দেয়। তাই ২০১৪ সালে বর্র্তমান সরকার প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রীসভায় হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ সম্প্রদায় নতুন করে আশার আলো খুঁজে পায়। এবং এক বছর পর, যখন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে তাদের কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। এতে করে ২০১৫ সালে ১২ জন হিজড়া’র সরকারী চাকরির ব্যবস্থা হয়, যা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের একটি অন্যতম পথ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।
বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে কথা হচ্ছে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে সতের কোটি মানুষের মাঝে এ অল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠীই ভুগছে অবহেলা আর বঞ্চনা সহ্য করে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য সূত্রমতে স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষে বর্তমান সরকার ৪ স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৭০০, মাধ্যমিক ৮০০, উচ্চ মাধ্যমিক ১০০০ এবং উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি প্রদান করেন। এবং ৫০ বছর তদুর্ধ বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা করে প্রদান করেন। ৫০ বছর তদুর্ধ বয়স্ক অক্ষম ও অসচ্ছল একজন ব্যক্তি মাসিক ৬০০ টাকা ভাতায় কি করে কাটায় একটি মাস? ফলে অভাব/অনটনের মাঝে জীবন যখন দূর্বিসহ ঠিক তখনি তারা যুক্ত হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি/যৌনকর্মী ও বিভিন্ন অপরাধ মূলক কাজে। কারণ একটাও তাদের জন্য সঠিক কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। কখনো কখনো কর্মস্থানের ব্যবস্থা হলেও সহ কর্মীদের সাথে তালমিলিয়ে উঠতে পারে না সহ মর্মীতার অভাবে ফিরে যেতে হয় তাদের পুরনো পেশায়, পাড়া/মহল্লায় দল বেধে দোকানে দোকানে চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে কখনো ভিক্ষাবৃত্তি/যৌনকর্মী আবার কখনো দেখা যায় বিভিন্ন অপরাধ মুলক কাজেও লিপ্ত হতে। তবে দিনবাদে যাই রোজগার করেন তার বেশির ভাগই চলে যায় তাদের সাজসজ্জা আর প্রসাধনী কেনাকাটায়।
বর্তমান মহামারির সময়েও দেখা যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি থেকে শুরু করে ব্যস্ততম নগরীর বিভিন্ন সিগন্যালে ভিক্ষাবৃত্তির চরিত্রে, করুন স্বর- আর চাহনিতে সাহায্যের আবেদন। প্রাইভেটকার, সিএনজি অথবা বাসের যাত্রীদের সাহায্যেই দিনাতিপাত করতে হয়। এই ক্ষুদ্র সংখ্যক হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) সম্প্রদায়কে। জীবনের প্রতিটি দিন কী তাদের এভাবে পরনির্ভর হয়ে চলতে হবে। বাল্য কাল থেকে জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত পরগাছার মত পরনির্ভর এ জীবনের শেষ কোথায়?
হিজড়াদেরকে বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু হিজড়াদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বদল হয়নি। এই সমাজে তারা এখনো অচ্ছুৎ। তাদের কাগজে কিছু অধিকার আছে বটে। কিন্তু বাস্তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় তারা অবহেলিত। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সম্মিলিত অনুদারতাই তাদেরকে অভিশপ্ত করে রেখেছে। তাই, হিজড়াদের দোষ ধরা শুধু নয়, সমাজের একটু সু-দৃষ্টি আর সহানুভূতিই ফিরে দিতে পারে একটি সু-সৃঙ্খল জীবন। এখন আমাদেরই তাদের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাদের জন্য প্রস্তুত করতে হবে একটি মানবিক সমাজ।