কোভিড-১৯ তথা প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্ব আজ টালমাতাল। প্রতিনিয়ত মিডিয়ায় আসছে করোনা ভাইরাস নিয়ে নতুন নতুন তথ্য। নতুন আর লাগামহীন করোনা ভাইরাসে এ পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ৯লাখ ২৪ হাজার (১২ সেপ্টেম্বর ২০২০) মানুষ মারা গেছে আর আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২কোটি ৮৯ লাখ মানুষ। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের দাপট কেড়ে নিয়েছে বিশ্ব নেতাদের চোখের ঘুম। করোনার করাল থাবা থেকে বিশ্বের মানুষকে রক্ষার জন্য দেশে দেশে বিজ্ঞানীরা দিনরাত অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেনো বিশ্ববাসীকে করোনার টিকা উপহার না দেওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের শান্তি নেই। শুধু তাই নয়, কার আগে কে করোনার ভ্যাকসিন বাজারে নিয়ে আসতে পারে সে নিয়ে চলছে জোর প্রতিযোগিতা। টিকা উৎপাদন ঘোষণাকারী প্রতিষ্ঠানের সহিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে চুক্তি সম্পাদন করতেও দেখা গেছে। করোনার টিকা উদ্ভাবনকারী দেশগুলোর মধ্যে আরাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই মোটেও।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে চীনের উহান প্রদেশে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ার পর তা ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়াতে শুরু করে। ৮ মার্চ, ২০২০ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ১৭ মার্চ, ২০২০ তারিখ থেকে বাংলাদেশ সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। করোনা ভাইরাসের করাল থাবা থেকে বাঁচতে দেশে অঘোষিত লকডাউন জারী করে মানুষকে রক্ষার চেষ্টা করা হয়। লকডাউন চলাকালীন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে মানুষকে করোনা হতে সুরক্ষিত থাকা বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। এ সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষকে সুরক্ষার জন্য সরকারি বে-সরকারি ভাবে ব্যাপক হারে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়। যদিও লকডাউনের সময়েও সারা দেশে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য বিধি না মানার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে শহরের সচেতন মানুষকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে দেখা গেলেও গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিধি মানার কোন বালায় ছিলো না।
যাই হোক, দীর্ঘ সময় লকডাউন থাকায় দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার স্বার্থে সরকার সীমিত পরিসরে সকল প্রকার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দেয়। স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণপূর্বক গাইড লাইন মেনে কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে মাঠ পর্যায়ে এর কোন বাস্তবতা নেই। সাধারণ মানুষ মাস্ক না ব্যবহার করেই এবং সামাজিক দুরত্ব বজায় না রেখেই স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় হাট-বাজার, অফিস-আদালত, গণ পরিবহণ কোথাও স্বাস্থ্য বিধি মানার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে গত ২৪ ঘন্টায় (১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে) করোনা ভাইরাসে মারা গেছে ৩১জন, নতুন সনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৪শত ৭৬জন । এ পর্যন্ত মারা গেছে মোট ৪ হাজার ৭শত ৩৩জন এবং আক্রান্ত হয়েছে মোট ৩লাখ ৩৭ হাজার ৫শত ২০ জন। সনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ১.৪০% এবং সুস্থ্যতার হার ৭১%। দেশে করোনায় সনাক্ত ও মৃত্যু হার স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে চললেও স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে মানুষের জীবণযাত্রা। করোনাকে মানুষ যেন কোন সমস্যাই মনে করছে না। যেন করোনা ভাইরাসের সাথে তাঁরা নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
এবার আসা যাক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা প্রসঙ্গে। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি করোনা ভাইরাস থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখার জন্য ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘœ ঘটছে এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। ইতিমধ্যেই সরকারকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার মেয়াদ কয়েক দফা বৃদ্ধি করতে হয়েছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩ অক্টোবর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার করা চিন্তা করে ইতিমধ্যেই প্রাথমিক সমাপণী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা এবং সমমানের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবে সরকার ঘরে বসে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ, অনলাইন ক্লাস এবং ঘরে বসে শিখি কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় উৎসাহ প্রদানের কার্যক্রম চলমান রেখেছে। সরকারের নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকার এ সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে কোমলমতি শিশু আর শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখার পদক্ষেপ হিসাবে। এদিকে বছরের অর্ধেকের সময় ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থী আর অভিভাবকরা পরবর্তি ক্লাসে সন্তানদের উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে রয়েছেন চরম উৎকন্ঠায়। কখন বিদ্যালয় খুলবে বা আদৌ খুলবে কিনা সে বিষয়ে তাঁরা কিচুই বুঝতে পারছেন না। এ বিষয়ে তাঁরা চেয়ে রয়েছেন সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিক্ষায়। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে বিদ্যালয় খোলা সম্ভব না হলে সেশন সময় বৃদ্ধি বা বিদ্যালয় ভিত্তিক শিক্ষার্থী মুল্যায়নের মাধ্যমে অটোপাস দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। যদিও এটির বিশ্বস্ত কোন সুত্র নেই।
শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে সরকার দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত অবশ্যই সুদুরপ্রসারী। সরকারের এই সিদ্ধান্ত লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ও পরিবারকে অজানা আতংক থেকে রক্ষা করেছে এবং শিক্ষার্থীদের করোনা ভাইরাস হতে সুরক্ষা দিয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো প্রতি দিন হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, গণ পরিবহণ, অফিস-আদালতে যারা ঠেলাঠেলি আর গাদাগাদি করে কোন প্রকার স্বাস্থ্য বিধি না মেনেই স্বাভাবিক কর্মকান্ড চলমান রেখেছে সে মানুষগুলো আসলে কোথা থেকে এসেছে। এই মানুষগুলো অবশ্যই কোন না কোন শিক্ষার্থী পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত। নিশ্চয়ই এরা কোন শিক্ষার্থীর বাবা, কাহারো ভাই, কাহারো মা, কাহারো বোন ইত্যাদি ইত্যাদি। যেহেতু দেশে স্বাভাবিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে সেহেতু মানুষের কিন্তু ঘরে থাকার সুযোগ নেই। ইচ্ছাকৃত ভাবেই হোক আর অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হোক মানুষকে জীবণ ও জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে ঘরের বাহিরে যেতে হচ্ছে এবং দিন শেষে আবারও ঘরে ফিরতে হচ্ছে। জীবণ ও জীবিকার তাগিদে যারা বাহিরে যাচ্ছেন তাদের কেউ স্বাস্থ্য বিধি মানছেন আবার কেউ মানছেন না। সঙ্গত কারণেই করোনার এই বিকাশ কালীন সময়ে ঘরের বাইরে যাওয়াটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে যারা পেশাগত কারণে বাড়ির বাহিরে যাচ্ছেন তাদের প্রত্যেকের না হলেও অধিকাংশরই ঘরে সন্তান রয়েছে। এই সন্তানরা কোন না কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছেন। এখন প্রশ্ন হলো দেশে স্বাভাবিক কর্মকান্ড চালু হওয়ায় অভিভাবকরা কাজে বাহিরে যাওয়ায় তাঁরা সহজেই করোনা ভাইরাসের জীবাণু ঘরে বয়ে নিয়ে আসতে পারেন বা নিয়েও আসছেন। কিন্তু গণহারে পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় হয়ত সেগুলো আমাদের নজরে আসছে না। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের ঘরে আটকে রেখে অভিভাবকদের ছেড়ে দিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের কতটুকু করোনা ঝুঁকি হতে নিরাপদে রাখতে পেরেছি সেটা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। অন্যদিকে উপজেলা শহরগুলির দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলেও শিক্ষার্থীরা কিন্তু ঘরে নেই। মাঝখানে এক থেকে দেড় মাস প্রাইভেট বন্ধ থাকলেও বর্তমানে তা দেদারছে প্রাইভেট ও টিউশনি চলছে। সকাল, দুপুর আর বিকেলে ঝাঁকে ঝাঁকে শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরদের কাছে ছুটছেন পড়ার জন্য। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষৎর এর কথা চিন্তা করে করোনার ঝুঁকি নিয়েই সন্তানদের প্রাইভেটে পাঠাচ্ছেন সন্তানের পিছিয়ে পড়ার আশংকার কথা চিন্তা করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলেও বাস্তবে শিক্ষার্থীরা কিন্তু মোটেও নিরাপদে নেই। বিদ্যালয়কে বাদ দিয়েইস্বাস্থ্য বিধিকে পাশ কাটিয়ে তাঁরা পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের বিদ্যমান করোনা বাস্তবতায় সরকার সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ কি সিদ্ধান্ত নিবেন সেটা সরকারের বিষয়। তবে পারিপাশ্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আমি মনে করি স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য সরকারি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে সেভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও খুলে দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে যে সকল প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যার চেয়ে অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে সেখানে দুই শিফটে বিদ্যালয় চালু করা যেতে পারে। গণ পরিবহণ ব্যবহার না করে বিকল্প পন্থায় অভিভাবকরা যাতে সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসতে পারে সে বিষয়ে তাদেরই দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশের পূর্বে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সকল শিক্ষার্থীদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করা যেতে পারে। করোনাকালীন সময়ে জাতীয় সংগীত, পিটি বন্ধ রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা স্থগিত রাখা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর শিক্ষকদের মাঝে যে হতাশা বিরাজ করছে তার দুর হবে এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। এটা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের করোনা মোকাবিলার সাহস যোগাবে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে তা লাঘবে ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে।
উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিক