সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা একটি। আমার কাছে শিক্ষাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার বলে মনে হয় কারণ “শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড”। শিক্ষার কারণেই ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ বৃদ্ধি পায়। মহামারী করোনা ভ্ইারাসের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গত ১৭ মার্চ থেকে কয়েক দফা বৃদ্ধি করে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে। পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই হয়ত সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আশা করছি দ্রুততম সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসবে। কারণ পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্থান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেক্ষেত্রে আমাদেরও ভাবতে হবে। সর্বশেষ করোনার কয়েকদিনের সংক্রমনের পরিসংখ্যানও পূর্বের তুলনায় নি¤œগামী। যেমন গত ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে মোট করোনাসনাক্ত হয়েছিল ১৮২৭ জন। গত ১০ সেপ্টেম্বর ১৮৯২ জন। গত ১১ সেপ্টেম্বর ১৭৯২ জন। গত ১২ সেপ্টেম্বর সনাক্তের সংখ্যা ছিল ১২৮২ জন। আর গত ১৩ সেপ্টেম্বর সনাক্ত ১৪৭৬ জন। সেই দিক বিবেচনা করলে সীমিত পরিসরে হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে মনে হয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তাছাড়া সকল সেক্টর করোনার প্রভাব মুক্ত ভাবেই চলছে বলা যায়। সকল সেক্টর স্বাভাবিক হলেও শিক্ষা সেক্টরটি অপূরনীয় ক্ষতি হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে ভিন্ন জনের মধ্যে। তবে তা মন্দের কিছু না কারণ জগতে সকল কাজেই বিভিন্ন মত ও পথ ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে গুরুত্ব বিবেচনা করে একমতে পৌছাতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা আমার কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে। সকল সেক্টর চালু রেখে শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে করোনা নিয়ন্ত্রন করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। সকল কিছুর একটি প্রধান ও অন্যান্য উপাদান থাকে। করোনা নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় সকল ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্খ্যবিধি মেনে চলা। আর এই অবস্থা ধরে রাখা প্রশাসনের কঠোরতা ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু সামাজিক দূরত্বের বালায় নাই, স্বাস্থ্যবিধির তেমন যাচায় নেই। আর প্রশাসন কঠোর নজরদারি রাখতে গিয়ে প্রশাসনের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঘরে। গত ৩০ আগস্ট চিকিৎসাজনিত কারনে গিয়েছিলাম জেলা শহর পাবনাতে। সেখানে জনসাধারণের ভীড়ে সড়ক পার হতে হিমসিম হয়ে পরেছিলাম। সড়কের চিত্র দেখে মনে হলো না করোনা দেশে আছে। আর গত ৪ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী থেকে রূপসা এক্সপ্রেসে গিয়েছিলাম ফুলবাড়িতে। দীর্ঘপথে কোথাও চোখে পরেনি কোন স্বাস্থ্যবিধি আরোপ। মনে হয় নি জনসাধারণের মনে করোনার প্রভাব। তাহলে করোনার কারণে শুধু শিক্ষাব্যবস্থারই ক্ষতি হচ্ছে এটা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়?
করোনার কারণে অনেক পরিবারেরই আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনই খোলা না গেলে ঝরে যাবে প্রায় পাঁচগুণ শিক্ষার্থী। ফলে দেশে শিক্ষার হার হবে নি¤œগামী। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে এই ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ১ শতাংশ। এর পর থেকে পাঁচ বছর নানা উদ্যোগের ফলে ব্যাপকভাবে ঝরে পড়া কমেছে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। মাধ্যমিকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ আর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৫৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ২০ দশমিক ০৮ শতাংশ, আর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে এই স্তরেও ঝরে পড়ার হার ছিল ৪২ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থনীতির চাকা সচল থাকার সময় যদি এই পরিসংখ্যান হয় তাহলে অর্থনৈতিক দূরাবস্থা ও দীর্ঘদিনের পড়ালেখার অভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। এই ঝরে পরা সন্তানগুলোকে তাদের অভিভাবকরা বিয়ে দিবেন অপ্রাপ্তবয়সে। তারাও সচেতনতার অভাবে মরণফাঁদে পা দিবে। ফলে অপ্রাপ্তবয়সে মাতৃত্বকালীন বিভিন্ন বিপদে পড়বে তারা।
করোনার কারনে অনেক অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা পরীক্ষা হবে কি না এই ভাবনায় পড়ালেখায় দায়িত্বশীল ভ’মিকা রাখছেন না । বন্ধ প্রাইভেটসহ পড়ালেখা, দীর্ঘদিন এভাবে থাকলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসলেও মনোযোগ দিতে পারবে না। ফলে ঝরে পড়া ছাড়াও মধ্যম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পরিণত হবে নি¤œ শ্রেণির শিক্ষার্থীতে। আর পিছিয়ে পরবে মেধাবী শিক্ষার্থীগুলোও। কারণ সবকিছুই নিয়মিত একটি বিষয় থাকে। কথায় বলে, দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকলে চকচকে লোহায়ও মরিচা ধরে, ঠিক তেমনি দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে পরবর্তী কতবছরে সেই শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ মেধায় আনা সম্ভব হবে তা কিন্তু চিন্তার বিষয়। আবার শ্রেণির নির্দিষ্ট সিলেবাসটি সম্পূর্ণ না করলে আপনার সন্তান পিছিয়ে পরবে বা পরবর্তী শ্রেণিতে তার মেধার উপর প্রভাব পরবে আমার মনে হয় বিষয়টি আমরা অনেকেই ভাবছি না। অথ্যাৎ পরীক্ষা না হলেও প্রথম শ্রেণির বই আপনার সন্তানকে সম্পন্ন করতে হবে কারণ ্প্রথম শ্রেণির বই সম্পন্ন করলেই আপনার সন্তান দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভাল ফলাফল করতে পারবে। তাছাড়া সে অনেক কিছু আয়ত্ব করতে পারবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না গেলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকের সেই জ্ঞান থেকে কিন্তু অনেক পিছিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। প্রধানত এই তিনটি কারণেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা প্রাসঙ্গিক বলে আমার মত। তাছাড়াও বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচীগুলো ব্যাহত হচ্ছে যা শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অধিকাংশ শিক্ষার্থী আছে যারা প্রতিষ্ঠান বাদে নিজ বইটি পড়তে চায় না। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে সেই শিক্ষার্থী মূল বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে ফলে সে জানতে পারে না পাঠ্যপুস্তকের অনেক বিবরণ। এককথায় শিক্ষার্থীর সার্বিক দিক বিবেচনা করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিকল্প নেই। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ কাম্য নয়। আমরা অনেকে ভাবছি সন্তানের জীবন আগে পড়ালেখা পরে। কথাটি ঠিক, কিন্তু আমি যদি কোন নিয়ম-নীতি না মেনে করোনা জোনে বেপরোয়া চলাফেরা করে সন্তানকে ঘরে রাখতে চাই তাহলে সেটা কতটুকু যৌক্তিক হবে? করোনাতো আসলে বড়দের বেপরোয়া চলাফেরায় হবে, সন্তানরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে কি চলাফেরা করবে? না আপনি বাইরে চলে সন্তানকে কাছে না নিয়ে চলছেন প্রশ্নটা সকলের কাছে? গ্রাম্যভাষায় বলে, “বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট” আসলে আমাদের তেমনটা ভাবলে চলবে না। সরকার সবসময় জনসাধারণের ভাল চিন্তা করে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিন্তা করেই করোনা পরিস্থিতির স্বাস্থ্যবিধি সীমিত করেছে। আমার মনে হয় দেশের সরকারি ও এমপিওভুক্ত সকল শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তটা আরও আগেই আসতে পারত। কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছাড়া যেমন দেশ সমৃদ্ধ থাকে না ঠিক তেমনি সকল শিক্ষক এক কাতারে থাকলে শিক্ষার জন্য কোনটি প্রাসঙ্গিক তা বুঝতে বেশি সুবিধা হতো। দেশের একটি বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কথা বিবেচনা করেই প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে আমার মনে হয় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত পাশাপাশি বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে স্বাস্থ্যবিধি ও সঠিক নির্দেশনা মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। সেই সাথে নিদের্শনা বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং ও প্রয়োজন। সকল কিছুই একটি দিক বিবেচনা করে হয় না বা করা যায় না। শিক্ষা সেক্টরটিও তেমন। করোনার সংক্রমনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, সুস্থতা, ঝরে পরা ও দেশের সাক্ষরতার হার সব বিষয়ই বিবেচনায় আনতে হবে। আসুন আমরা সন্তানের পড়ালেখায় দায়িত্বশীল হই। শুধু পরীক্ষা নয়, মানসম্মত শিক্ষায় নজর দেই। সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট