জনগণের জীবন মান নিয়ন্ত্রণের বড় নিয়ামক হলো সেদেশের বাজার ব্যবস্থা। বাজার যদি অস্থির হয় বা দ্রব্যমূল্য যদি ওঠানামা করে তাহলে জনগণের জীবনমানও ওঠা নামা করে। গড় আয় বৃদ্ধি পেলে অস্থির বাজার কোনো দেশের অভ্যন্তরের জন্য স্বস্তির হতে পারে না। দেশের নিন্ম ও মধ্যবিত্ত মানুষের প্রধান টেনশনের কারণ থাকে বাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। মাছ,মাংস,তেল,ডাল,লবণ,মরিচ,আলু,আদা,পিঁয়াজসহ প্রতিদিনের আবশ্যকীয় উপকরণগুলোই এসব মানুষের দুশ্চিন্তার বড় কারণ। তিনবেলা খাওয়ার পেছনেই যদি একটি পরিবারের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় করতে হয় তখন বাকি মৌলিক চাহিদা পূরণ কঠিন হয়ে পরে। ইদানিং মাঝে মাধ্যেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। কখনো চাল, কখনো পিঁয়ায়,কখনো তেল,মরিচ ইত্যাদি এক বা একাধিক পণ্যের দাম বৃৃদ্ধি পাচ্ছে। যা দরিদ্র ক্রেতাদের জন্য অস্বস্তির কারণ। এই করোনাকালীন সময়ে জীবন যাপন এমনিতেই নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের জন্য কষ্টের তারপর বাজারের এই চিত্র তাদের নাকাল করে দিচ্ছে। অথচ সবার জন্য সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে বাজার ব্যবস্থা দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে মানুষের জীবন যাত্রা পরিবর্তনের যে টানাপোড়েন শুরু হয় তার অন্যতম হলো আর্থিক সমস্যা। বেকার বা অর্ধবেকার জীবন যাপন করতে শুরু কর বহু মানুষ। এখনো ঘুরে দাড়াতে আরও সময় লাগবে। এরই মধ্যে বন্যার প্রকোপ মানুষকে নাজেহাল করে দেয়। বাজার অগ্নিমূল্য হয়ে ওঠে। জনগণের জীবনমান আরামদায়ক করতে সবচেয়ে আগে দরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ। সাধারণ মানুষ যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে ভোগান্তিতে না পরে সেটাই প্রধান দায়িত্ব। মাঝে মাঝে সিন্ডিকেট নামের একটি শব্দ খুব আলোচিত হয়। দেশে পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও যখন বাজারে তার দাম বাড়তে থাকে তখন বুঝতে হবে সেখানে কোনো অদৃশ্য হাতের কারসাজি রয়েছে। যার নাগাল সাধারণ ক্রেতা পায় না। সব যেন সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। চালের বাজার, পিঁয়াজ আবার সম্প্রতি আলুর দামও যেন ক্রমেই নাগাল ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কতৃপক্ষ আলুর দাম বেঁধে দিয়েছে।
তারপরও কি বেঁধে দেওয়া দামে সব জায়গায় তা বিক্রি হচ্ছে? এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজার অস্থির করে। আলু এমন একটি সবজি যা প্রতিদিন একেবারে নিন্ম বিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবার প্রয়োজন। সেই তরকারি হঠাৎ মূল্য বৃদ্ধিতে বিপাকে নিন্মবিত্ত মানুষেরা। তাছাড়া চালের বাজারও মাঝে মধ্যেই ওঠা নামা করছে। কোনো কারণ না থাকলেও বা যথেষ্ট মজুদ থাকলেও কেন চাল,পিঁয়াজ বা আলুর দাম বৃদ্ধি পায় তার উত্তর কে দেবে? বন্যার কারণে তো বহুদিন ধরেই কাঁচামরিচের ঝাঁল ক্রেতাদের ভোগাচ্ছে। এই যে চালের দাম বৃদ্ধি পায় তার পেছনের কারণ কি? মাছে-ভাতে বাঙালি তো মাছ আর চালের দাম বৃদ্ধি পেলে অস্থির হবেই? অস্থির বাজারের সাথে অস্থির জনজীবন। ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্ত বাজারের আগুনের আচ লাগছে সাধারণ মানুষের উপর। বলা যায় এই তাপে তারা রীতিমত জ্বলছে। কারণ এ জ্বালা কেবল যারা নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির তাদেরই বেশি। এমনিতেই করোনাকালে খাঁড়া নেমেছে মধ্যবিত্তের ওপর। তারপর আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিশেষ করে সবজির বাজার চড়া। নিন্ম আয়ের মানুষের স্বপ্ন এখন চাল কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত হলো এমন এক শ্রেণির মানুষ যারা দুই শ্রেণির মাঝে থেকে সারা জীবন চ্যাপ্টা হয় কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। যে শ্রেণির মানুষের কাছে ফেব্রুয়ারি মাসটাই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলে আর একত্রিশ দিনে মাস হলো একদিনের বোঝা। যারা লাইনে দাড়িয়ে আত্নসম্মানের ভয়ে সাহায্য নিতে পারে না। এমনকি ঘরে একবেলা না খেয়ে থাকলেও কিছু বলতে পারে না। কারণ ওই আত্নসম্মান।
করোনার মহামারীতে সারা বিশে^ যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তখন এই মধ্যবিত্তরা রয়েছে মহাসমস্যায়। সংসার সামলানোর চিন্তায় তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সেই ভাঁজ কেউ দেখছে না। পাঁচ জনের একটি পরিবারে যদি একজন উপার্জন ক্ষম ব্যাক্তি থাকে তাহলে চাল,ডাল,সবজি কিনতেই প্রতিদিনের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে। এরপর আবার রয়েছে চিকিৎসা খরচ, পোশাক খরচ এবং এরকম হাজারটা খরচ। একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো, কারও আয় যতটুকুই বৃদ্ধি পাক তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখা। কোনোভাবেই যেন তা হাতের নাগালের বাইরে না যায়। বাঙালি ভাত প্রিয় মানুষ। তাই চালের মূল্য বৃদ্ধির খবরে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এরপর যদি আবার সবজির বাজারও হাতের নাগালের বাইরে থাকে তাহলেও তো আরও সমস্যা।
পত্রিকায় খুললেই চোখে পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে গরীবের পেটের আহার চলে যাচ্ছে অসৎ পয়সাওয়ালাদের পেটে। সারাদিন পর হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে কেবল দুমুঠো ভাতের স্বাদ নিতে চায় সাধারণ মানুষ। ওরা ঠিক বোঝে না চালের দাম এত বাড়ছে কেন। ওরা শুধু জানে চাল কিনতেই পকেটের পয়সা ফুরিয়ে যাবার জোগাড় হচ্ছে। প্রথম থেকেই এটি কৃত্রিম সংকট বলে যে দাবী করা হচ্ছিল অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ সে কথার সত্যতার প্রমাণ করে। তাছাড়া চাল আমদানিও হচ্ছে। তাহলে আমরা আশা করতেই পারি খুব দ্রুতই চালের বাজার স্বাভাবিক হবে। বাজারে চালের দাম বাড়বে সিন্ডিকেটের দৌরাতেœ, পিঁয়াজ সেখানেও সিন্ডকেট, আলু সেখানেও একই অবস্থা। তাহলে সাধারণ নিন্মবিত্ত,মধ্যবিত্ত মানুষগুলো কোথায় দাড়াবে? বাজার করতে গিয়েই তার দৈনিক আয়ের বেশিরভাগ অংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে পরিবারের অন্য আবদার সে কিভাবে পূরণ করবে? তারও তো সন্তান আছে। তাদের ইচ্ছে হয় বাবার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার। তারা বাজার বোঝে না। বাবা যদি বলে বাজারে জিনিসপত্রের খুব দাম তাতে তারা খানিকটা অবাকই হয় বটে। নিত্যদিন যখন সকালে উঠে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বিরস মুখে বাজারের দিকে রওনা হয় তখন জিনিসপত্রের দাম তাকে অস্থির করে তোলে। সাধারণ মানুষের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে নিজের পকেট মোটা থেকে মোট করে যারা ব্যাবসা বাড়ানোর চেষ্টা করে এবং তাদের এই অসাধু প্রচেষ্টায় জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এইসব কালো মুখোশধারী ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে ছাড়ে না। লোভীদের কালো হাতের দৌরাত্ন কতদূর? সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে তাদের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে পুজিপতি বনে যাবার ঘৃণ্য মানসিকতা কোন সভ্য সমাজের হতে পারে না। মানুষের জীবনযাপন তখনি সুন্দর হবে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে। যেকোনো ভাবেই হোক বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সাধারণ ক্রেতারা যাতে তাদের আয়ের মধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা পূরণ করতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলাম লেখক