সেলিব্রেটি শব্দটির অর্থ আসালে কি? জনপ্রিয়তা অর্জন নাকি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া বা পরিচিত হয়ে যাওয়া? আজকাল এই তথাকথিত সেলিব্রেটি হওয়ার নেশা যুব সমাজের ঘাড়ে চেপে বসেছে তার থেকে মুক্তির উপায় নেই। মোবাইলে চোখ ফেললেই এসব কিশোর কিশোরীদের সেলিব্রেটি হওয়ার কান্ড কারখানা চোখে পরে। কত রকমের সেলিব্রেটি আছে আজ। ফেসবুক সেলিব্রেটি, টিকটক সেলিব্রেটি আরও কত ধরনের যে সেলিব্রেটি আছে তার ইয়ত্তা নেই। আগে আমরা টিভি তারকাদের বা খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেককেই জনপ্রিয় বলে মনে করতাম। আজ জনপ্রিয়তা সে পর্যায়ে নেই। সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটেছে তো! টিভি চ্যানেলের সেলিব্রেটি হওয়ার চেয়ে মোবাইলের বিভিন্ন মাধ্যমে সেলিব্রেটি হওয়া বেশ সহজ। তাতে দর্শকদের মানে সেই ভিউয়ারসদের মন যোগাতে পারলেই ভিউ,লাইক বা কমেন্টস পাওয়া যায়। আজকের যুগ হলো লাইক,ভিউ বা কমেন্টেসের যুগ। কোন ভিডিও আপলোড করার পর কয়টা লাইক পেলো বা কতজন ভিউ হলো এসব নিয়েই হিসাব নিকাশ করা হয়। এখন দেশে এত এত চ্যানেল। রিমোট ঘুরালেই সেসব চ্যানেল দেখা যায়। তবে মানুষের সময় কম। তাছাড়া হাতে হাতে বিনোদনের মাধ্যম এন্ড্রোয়েড মোবাইল ফোন থাকতে ঘরে বিনোদনের এত সময় কোথায়? এই সুযোগেই এসব মোবাইল সেলিব্রেটিদের আতœপ্রকাশ। কিন্তু এসব আমাদের যুব কিশোরদের কোথায় নিয়ে দাড় করাচ্ছে? টিকটক বা লাইকি’র মতো অ্যাপস আমাদের দেশের উঠতি তরুণ তরুণিরা ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। এসব অ্যাপস ভিত্তিক মজার মজার ভিডিও তৈরি করছে তারপর আপলোড করছে। আর আমরা ভিউয়ারস বা দর্শকরা তা দেখছি। লাইক করছি বা কমেন্টস করছি।
এসব কিশোরদের পোশাক বা ষ্টাইল আমাদের দেশের সংস্কৃতির নয়। বরং তা পশ্চিমা বিশে^র অনুকরণমাত্র। আমাদের মাথায় চেপে বসেছে সেলিব্রেটি হওয়ার নেশা। অবশ্য সেলিব্রেটি হতে চাই আমরা সবাই। কিন্তু তার জন্য ধৈর্য প্রয়োজন। কাজের প্রতি একাগ্রতা প্রয়োজন। আবার দেশপ্রেমও প্রয়োজন। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব অ্যাপসের নাম উঠে এসেছে যা তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করতে পারে। কিশোরদের সামাজিকতার পরিবর্তন, আচরণে অতি আধুনিকতার প্রকাশ, মূল্যবোধের প্রচন্ড অভাব, নিজস্ব সংস্কৃতি বর্জন,কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পরা ও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পরা এসব হচ্ছে কিছু অ্যাপস ব্যবহার করে। উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীদের একটি অংশ যারা এসব ভিডিও চ্যাট করতে অভ্যস্থ বা টেক্সট চ্যাট করে তারা এসব ফাঁদে পা দেয়। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পরে। কেবল যৌনতাই নয় বরং নানা প্রলোভনে পরে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তারা নিজেরা। এর মধ্যে কিছুদিন আগে টিকটক সেলিব্রেটি যখন একটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন তখন এই অপসংস্কৃতির অনুসরণ নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হয়। আমাদের তো এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তা সেলিব্রেটি হওয়ার নেশায় নয়। এসব ভিডিও কন্টেন্টে তরুণীদের নাচ গান আর অঙ্গভঙ্গি ঠিক আমাদের সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না। এর পুরোটাই বিদেশি সংস্কৃতির ঢঙে তৈরি করছে এবং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কারা এদের জনপ্রিয় করে তুলছে? এদের জনপ্রিয় করেছে এই যুগেরই তরুণ তরুণীরা। এটা আসলে একরকম নেশার মতো হয়ে গেছে। জনপ্রিয় হওয়ার নেশা। এই নেশা একবার ধরলে তা থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল।
এতদিন আমরা টিভি চ্যানের নিয়েই বিপাকে ছিলাম। কারণ আমাদের ঘরে ঘরে সিরিয়াল সংস্কৃতি ঢুকে গেছে। ক্রাইম সিরিয়াল অনুরণে দেশে খুনের ঘটনাও ঘটছে। এসব সিরিয়াল আমাদের দাম্পত্যকে বিপর্যস্থ করে তুলেছে। সারাদিন শুধু একের পর এক সিরিয়াল। সেসব সিরিয়ালের জুড়েই থাকে একাধিক সম্পর্কের রসায়ন। ভালো কিছুও থাকে সেখানে। কিন্তু আমরা ভালো কিছু গ্রহণ করতে শিখিনি। আমরা শিখেছি ভালোর মধ্যে থেকে খারাপটাকে গ্রহণ করতে। তাই আমাদের দেশে সংসার ভাঙছে। স্বামী স্ত্রীর বিশ^স্ত সম্পর্কে চিড় ধরেছে। নতুন সম্পর্ক তৈরি করছে। এই সংস্কৃতি আমাদের নয়। আমাদের দেশ বিশ^স্ত সম্পর্কে বিশ^াস করে। কিন্তু আমরা কি শিখছি তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিদেশি সংস্কৃতি ভালবাসতে গিয়ে নিজের সংস্কৃতি হারাতে বসেছি। নিজ সংস্কৃতিকে ভুলে যাবার মূঢ়তার ভেতর আনন্দেরও কিছু নেই। বরং তা খানিকটার লজ্জার। এই লজ্জা আমরা পেতে ভালোবাসি। লজ্জাও আমরা মজ্জাগত করে নিয়েছি। আজ সকাল বিকেল রাতে টিভি বাইরের চ্যানেলে সিরিয়াল দেখা হয়। সেসব সিরিয়ালে দেখানো সংস্কৃতি আমাদের ছিল না কোনোদিন। আমাদের পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে খুব দ্রুত। দেশে একান্নবর্তী পরিবার গুড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। তারপর স্বামী,স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে পরিবার গড়ে উঠেছে। সেসব অনেক পরিবারেই আজ ভাঙণের সুর। স্বামী স্ত্রী আলাদা হচ্ছে। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। সন্তান আলাদা হচ্ছে তার বাবা অথবা মা’র কাছ থেকে। এভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। অপরাধ বাড়ছে। তাতে সিরিয়াল দেখার অভ্যাস কমেনি বরং বেড়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে কিভাবে একটি সিরিয়াল মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে? সহজ কথায় মানুষ অনুকরণ করতে ভালোবাসে। অর্থাৎ কোনো নায়ক বা নায়িকা যে পোশাক ব্যবহার করে সেই ধরনের পোশাক তৈরির প্রতি বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হয়। এভাবে সিরিয়ালে যখন পারিবারিক অশান্তি দেখানো হয়, কোন্দল দেখানো হয় তখন তা ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব ফেলে। একসময় মন তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়। খুব কম মানুষই আছে যারা অনুকরণ বা অনুসরণ থেকে দূরে থাকতে পারে।
এখন মনে হয় টিভি চ্যানেলের যুগও পার করে যাচ্ছি। কারণ আজকাল সিনেমা,নাটক দেখার জন্য টিভি সেটের সামনে আমাদের তরুণ প্রজন্ম হাজির হয় না। তাদের এত সময় নেই। তারা রাস্তার ধারে, গলির মোড়ে দাড়িয়ে মোবাইল সেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে তারা নাটক দেখে, সিনেমা দেখে, ভিডিও দেখে বা গেমস খেলে। এক্ষেত্রে তাদের রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। কারণ আপনার সন্তান বাড়িতে যতক্ষণ থাকবে আপনি হয়তো তার হাতের ডিভাইসের ওপর নজরদারি করতে পারবেন কিন্তু যখন বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় থাকবে তখন নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। সে বন্ধুদের উৎসাহেও পর্ণোগ্রাফিতে ঝুঁকতে পারে যা উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীর কাছে ব্যাপক আগ্রহের এবং মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ণ বা অন্য কোনো ক্ষতিকর সাইটে যেতেই পারে যা তার মনোজগতে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। তাদের ঠেকানোর উপায় নেই। আবার তারা যখন সেই বহু জনপ্রিয় অ্যাপসের মাধ্যমে তাদের প্রিয় তারকার অনুকরণ করে চায় তখনো তাদের রোধ করার উপায় নেই। তারা অনেকেই এসব অ্যাপসভিত্তিক তারকাদের দেখে নিজেরাও রাতারাতি বিখ্যাত হতে চাইছে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যখন তারা এর মাধ্যমে যৌনতায় প্রলুব্ধ হচ্ছে, কোনো অপরাধে জড়াচ্ছে বা নিজের প্রধান লক্ষ্য লেখাপড়ায় দুর্বল হচ্ছে তাতে আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয় রয়েছে। এগুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার দায়িত্ব, তাদের সঠিক পথ দেখানো দায়িত্ব আমাদেরই। তাদের আমাদের নিজস্ব সংস্কতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্বও আমাদেরই কাঁধে। রাতারাতি যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা যায় না আর গেলেও তা ধরে রাখা যায় না তা তাদের বোঝাতে হবে। একজন প্রকৃতি সেলিব্রেটি হয় বিনয়ী, ভদ্র এবং সত্যিকারের পরিশ্রমী। তারা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয় বরং সংস্কৃতির ধারক।
অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলাম লেখক ,পাবনা।