উপকূলীয় অঞ্চল লক্ষ্মীপুরের ‘লক্ষ্মী’ হিসেবে পরিচিত অর্থকরী ফসল সুপারির এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। সুপারির বাম্পার ফলন ও ভালো দামে খুশি স্থানীয় সুপারির বাগান মালিকরা। এ কারণে তারা রয়েছেন খোশমেজাজে। করোনার এই ক্রান্তি কালে সুপারির ভালো দাম পেয়ে হাসি ফুটেছে সুপারির বাগান মালিকদের মুখে। লক্ষ্মীপুরের মাটি ও আবহাওয়া সুপারি উৎপাদনে উপযোগী। এ জনপদের এমন কোনো বাড়ি নেই যে বাড়িতে সুপারি গাছ নেই। এছাড়াও বিশাল-বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে সুপারি বাগান। সুপারির বাগান করে উৎপাদন করা হচ্ছে শত-শত কোটি টাকার সুপারি। অর্থকারী এ ফসলকে ঘিরে এ অঞ্চলে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। উৎপাদিত এ ফসলের বাজার দর ভালো থাকায় সুপারি চাষে আগ্রহ বাড়ছে এখানকার মানুষের।
এদিকে সদর উপজেলার দালাল বাজার, ভবানীগঞ্জ, মান্দারী, জকসিন, চন্দ্রগঞ্জ ও রায়পুর বাজার ও খাসের হাটসহ অন্তত শতাধিক স্থানে সুপারীর হাট বসে।জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে, এখানকার উৎপাদিত সুপারি। তবে এখানে প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র থাকলে সুপারি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো।
সংশি¬ষ্টরা জানান, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সুপারি গাছে ফুল আসে। পরে এ ফুল থেকে সৃষ্ট সুপারি পুরোপুরি পাকে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে। মূলত কার্তিক মাস আর অগ্রহায়ণ মাসেই সুপারির ভরা মৌসুম। তবে এবার সময়ের আগে বাজারে এসেছে সুপারি। আশ্বিন মাসের শুরুর দিকে বাজারে সুপারি আসতে শুরু করে। এতে সুপারি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় বিভিন্ন হাট-বাজারে সুপারি ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে ৬ হাজার ৮৭৬ হেক্টর জমিতে সুপারি বাগান রয়েছে। আর এসব বাগানে এ বছর উৎপাদিত হয়েছে ১৩ হাজার ৬৭৪ টন সুপারি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১ হাজার ৯১০ হেক্টর, রায়পুর উপজেলায় ৩ হাজার ৭১৭হেক্টর, রামগঞ্জ উপজেলায় ৮৯৮ হেক্টর, কমলনগরে ২৭০ হেক্টর ও রামগতি উপজেলায় ৫৫ হেক্টর জমিতে সুপারির বাগান রয়েছে। এ মৌসুমে উৎপাদিত সুপারির বাজার মূল্য প্রায় চার’শ কোটি টাকা হবে বলে ধারণা করছেন সংশি¬ষ্টরা।
জেলার প্রতিটি বাজারেই প্রচুর পরিমাণে সুপারি আসতে দেখাগেছে। এখানকার সুপারির প্রায় ৭০ ভাগ নদীনালা, খালডোবা, পুকুর ও পানিভর্তি পাকা হাউজে ভিজিয়ে রাখেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আর ৩০ ভাগ সুপারি দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ ছাড়াও রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এ বছর কাঁচা-পাকা সুপারির ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষী, গৃহস্থ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। লক্ষ্মীপুরে সুপারির প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র না থাকায় অনেক সময় কৃষকরা সুপারির ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।
জানা যায়, সুপারি গাছ একবার রোপণ করলে তেমন কোনো পরিচর্যা ছাড়াই টানা ৩৫-৪০ বছর ফলন দেয়। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশী আয় করা যায়। সুপারি বাগানে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কিংবা রোগ-বালাই কম থাকায় এ অঞ্চলের কৃষকরা সুপারি চাষের দিকে বেশী ঝুঁকেছেন। এ বছর মৌসুম শুরু হওয়ার আগ থেকেই সুপারি বিক্রির প্রধান মোকাম সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর শহর, দালাল বাজার, চররুহিতা, ভবানীগঞ্জ, মান্দারী, দত্তপাড়া, জকসিন, রায়পুর উপজেলা শহর, হায়দরগঞ্জ বাজার, সোনাপুর, দেনায়েতপুর, খাসেরহাট, মোল্ল¬ারহাট, রামগঞ্জ উপজেলা শহর, কাঞ্চনপুর বাজার, করপাড়া বাজারসহ জেলার প্রতিটি বাজারে সুপারিকে ঘিরে বর্তমানে চলছে জমজমাট ব্যবসা।
এখানকার প্রতিটি বাগানে সুপারি পেকে হলুদের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। বাগানে এখন পাকা সুপারির হলুদ রঙয়ের সমারোহ, মাইলের পর মাইল পাকা সুপারির হলুদ রঙয়ে চেয়ে গেছে। তাঁতে হাঁসি পুটেছে সুপারির বাগান মালিকদের মুখে। গাছ থেকে সুপারি সংগ্রহ, ভিজিয়ে রাখা এবং বাজারজাত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সুপারি চাষীরা।
তাজল ইসলাম,সবুজ, মহসিনসহ কয়েকজন সুপারি চাষী জানান, সুপারি গাছের পরিচর্যা ও রক্ষণা-বেক্ষণে স্থানীয় কৃষি অফিসের সহযোগিতা এবং তদারকির কারণে গাছে রোগ-বালাই কম ও ফলন বেশি হয়েছে। গাছ রোপণ ও সুষ্ঠু রক্ষণা-বেক্ষণে কৃষি বিভাগের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নে লক্ষ্মীপুরে এ অর্থকরী ফসল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে বলেও জানান তারা ।
স্থানীয় কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা নিজেদের চাহিদামতো সুপারি স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছেন।
এ বছর প্রতি পোন সুপারি (৮০টি) মাণভেদে ১৩০ টাকা থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত কয়েক বছরের তুলনায় বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আবুল হোসেন জানান, সুপারি লক্ষ্মীপুরের অর্থকারী ফসলের মধ্যে একটি অন্যতম ফসল। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সুপারি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। সুপারি চাষ, পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিষয়ে কৃষি বিভাগ চাষীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আসছে। সুপারি বাগান করার মধ্য দিয়ে এখানকার কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার কাঁচা-পাকা সুপারির দাম কিছুটা বেশি। এতে ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষীরা।