সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি উদ্যোক্তারা আশানুরূপ আগ্রহী হচ্ছে না। সেজন্য তালিকাভুক্ত অনেক প্রকল্পই পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে না। এমন অবস্থায় পিপিপি কর্তৃপক্ষের নির্বাহী বোর্ড বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষণীয় নয় এমন প্রকল্প পিপিপির তালিকা থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে পিপিপির আওতায় বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া ৭৭ প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি এ প্রক্রিয়ায় বাদ পড়তে যাচ্ছে। পিপিপি কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সম্প্রতি পিপিপি কর্তৃপক্ষের নির্বাহী বোর্ডের সভা হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয় পিপিপির আওতায় পাইপলাইনে থাকা ৭৭টি প্রকল্পকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনকগুলো রেখে বাকি প্রকল্প বাদ দেয়া হবে। তারপরই পিপিপি কর্তৃপক্ষ প্রকল্প পর্যালোচনা শুরু করেছে। আর প্রাথমিক পর্যালোচনায় অর্ধেকের বেশি প্রকল্পই লাভজনক নয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কয়েকটি প্রকল্প পিপিপি কার্যক্রমের শুরুর দিকে নেয়া হয়েছিল কিন্তু সেগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। কয়েকটি প্রকল্পে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে। আবার কয়েকটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই এখনো শেষ হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পগুলোর অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা চলছে। শিগগির যাচাই-বাছাই শেষ করে কতগুলো প্রকল্প পিপিপিতে বাস্তবায়নের জন্য রাখা যাবে তা চূড়ান্ত করা হবে। পিপিপি প্রকল্পের বাণিজ্যিক দিকের পাশাপাশি পদ্ধতিগত জটিলতা, পিপিপি কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে কোনো টার্গেট না থাকা এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জনবলের ঘাটতিও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার অন্যতম কারণ।
সূত্র জানায়, বিগত ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ধারণা নিয়ে আসে। সেজন্য ওই বছরের বাজেটে আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও রাখা হয়। ওই থেকে প্রতি বছরের বাজেটেই বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় ওই টাকা খরচ হয় না। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। প্রকল্পের কারিগরি সহায়তা, ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) ও মূলধনি বিনিয়োগের জন্য সরকার এ বরাদ্দ রাখে। এখন পর্যন্ত মাত্র একটি প্রকল্পের ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) বাবদ মাত্র ২২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বিগত ২০১০ সালে পিপিপির আওতাভুক্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে এ সংক্রান্ত একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে এ বিষয়ে আলাদা আইনও করা হয়েছে। পিপিপি কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত ৭৭টি প্রকল্পকে এ ব্যবস্থায় বাস্তবায়নের জন্য তালিকাভুক্ত করেছে। ওই ৭৭ প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন।
সূত্র আরো জানায়, সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক প্রকল্পে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখায়। পিপিপিতে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেগুলোর বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা ঠিকমতো যাচাই হয়েছে কিনা এবং এসব বিষয় যাচাই করার উপযুক্ত কর্মকর্তা পিপিপি অফিসে আছে কিনা তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওই সভায় মন্ত্রণালয়গুলোর উন্নয়ন প্রকল্পের ৩০ ভাগ পিপিপিতে বাস্তবায়নের নির্দেশনা কতোটুকু বাস্তবসম্মত, তা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মপরিধিতে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক প্রকল্প থাকে না। ফলে ওই নির্দেশনা বাস্তবসম্মত নয়। গত ১০ বছরে যেসব প্রকল্প নিয়ে পিপিপি কর্তৃপক্ষ কাজ করেছে তাতে দেখা গেছে প্রধানত ১৫টি মন্ত্রণালয়ে পিপিপি-সংশ্নিষ্ট প্রকল্প রয়েছে। পিপিপি কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি হাসপাতাল এখন পর্যন্ত পিপিপির আওতায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আর নির্মাণ পর্যায়ে রয়েছে ৬টি প্রকল্প। ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। আর চুক্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে দুটি প্রকল্প। তাছাড়াও কিছু প্রকল্পের মূল্যায়ন চলছে। কোনো কোনো প্রকল্প দরপত্র আহ্বান করেও বেসরকারি অংশীদার পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো প্রকল্পে পুনঃদরপত্র দেয়া হচ্ছে। কিছু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। আর ১৬টি প্রকল্প নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, পিপিপি বিষয়ে অনেক কিছুই করা হয়েছে। কিন্তু আবার কিছুই হয়নি। প্রকল্পগুলোর যথাযথ বিশ্নেষণ হয়নি। বড় প্রকল্পের যে ধরনের আর্থিক ও মুনাফাকেন্দ্রিক বিশ্নেষণ হওয়া উচিত তা করা হয়নি। আবার বেসরকারি খাতের জন্য আকর্ষণীয় প্রকল্প থাকলেও জমি অধিগ্রহণসহ কিছু কাজ সময় মতো করা যায়নি। পিপিপিতে এমন ব্যবস্থা ও প্রকল্প থাকতে হবে, যাতে বেসরকারি খাত আকৃষ্ট হয়।
অন্যদিকে এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান জানান, ব্যবসায়ীরা লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে কাজ করে। পিপিপিতে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে সেখানে প্রত্যাশিত মুনাফার হার আশানুরূপ নয়। সরকার অনেক আকর্ষণীয় প্রকল্প নিজে বাস্তবায়ন করছে। আর পিপিপির প্রকল্পগুলো বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষণীয় নয়। এখন নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে নতুনভাবে সাজাতে হবে। নতুনভাবে নকশা করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে সড়ক হচ্ছে পিপিপির আওতায় এবং ওই সড়কের কারণে যেসব নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে, সেখান থেকে আসা করের অংশ পাচ্ছে পিপিপির বেসরকারি অংশীদার। তবে বাংলাদেশে পিপিপিতে দক্ষ জনবলেরও ঘাটতি আছে। এ বিষয়ে ভারত, থাইল্যান্ড অন্যান্য দেশের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।