অবাধে সরকারি গাড়ির অব্যবহার চলছে। বার বার তাগিদ দিয়েও তা রোধ করা যাচ্ছে না। গত ৩ বছরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি গাড়ির অপব্যবহার বন্ধে এশাধিকার চিঠি দিয়ে কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রভাবই পড়েনি। বরং গাড়ি অপব্যবহার দিব্বি অব্যাহত রয়েছে। ফলে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের এমন আচরণে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সরকারি পরিবহন পুল সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাই সুদমুক্ত সুবিধায় ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনলেও তাদের অনেকেই আগের মতোই বহাল-তবিয়তে মন্ত্রণালয়, দফতর ও সংস্থার গাড়ি ব্যবহার করছে। পাশাপাশি নগদায়ন সুবিধায় কেনা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে বেতনের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা রক্ষণাবেক্ষণ ভাতা তুলে নিচ্ছে। ফলে প্রাধিকারপ্রাপ্ত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে গাড়ি নগদায়ন সুবিধা দেয়ার পরও পরিবহন পুলসহ বেশির ভাগ দফতরে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ খাতে খরচ মোটেও কমছে না। বরং কোথাও কোথাও বেড়েছে।
সূত্র জানায়, সুদমুক্ত ঋণ সুবিধায় গাড়ি কেনার পর সরকারি গাড়ি ব্যবহার নৈতিক কারণে খুবই কম সংখ্যক কর্মকর্তাই ছেড়ে দিয়েছে। তেমন কর্মকর্তার সংখ্যা শতকরা ১০ জনের বেশি হবে না। অথচ যারা ঋণ নিয়ে যেসব কর্মকর্তা গাড়ি কিনেছেন তাদের নৈতিক ও আইনগত কারণেই দফতরের সরকারি গাড়ি ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু এখনো অনেকেই অবলীলায় সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে যাচ্ছে। ফলে তারা একই সঙ্গে দুটি অপরাধ করছে। প্রথমত, এ বিষয়ে বিদ্যমান নীতিমালা অমান্য করে বিভাগীয় মামলার সম্মুখীন হওয়ার মতো অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। অপরটি ৫০ হাজার টাকা গাড়ি ভাতা তুলে প্রকান্তরে সরকারি অর্থ তসরুপের অপরাধ করছে। যা দুর্নীতির শামিল। এ বিষয়ে প্রথমদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকেও চিঠি দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও সতর্ক করে চিঠি ইস্যু করেছে। কিন্তু এতো বিধিনিষেধের পরও অনেক কর্মকর্তাই কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। মূলত তারা খুবই প্রভাবশালী। মূলত যতোক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যমান বিধিবিধানের শক্ত প্রয়োগ করা হবে না, ততোদিন সরকারি গাড়ির অপব্যবহার ও অনিয়ম-দুর্নীতি চলতেই থাকবে।
সূত্র আরো জানায়, প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ সুবিধায় কেনা গাড়ির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সর্বশেষ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে গত ২৮ অক্টোবর চিঠি পাঠানো হয়। তার আগে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর এ বিষয়ে প্রথম চিঠি পাঠানো হয়। তারপর ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর, ২০২০ সালের ৮ মার্চ এবং গত ২৩ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন থেকে সরকারি গাড়ির অপব্যবহার রোধে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ফলাফল শূন্য। শেষ দফার চিঠিতে কঠোর ভাষায় সতর্ক করে বলা হয়েছে, যারা এহেন কাজ করবেন তারা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। অসদাচরণ একটি গুরুদ-ের অপরাধ।
এদিকে সরকারি গাড়ির অপব্যবহার প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিমত, রক্ষকরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে কারোর কিছু করার থাকে না। সরকারি গাড়ির অপব্যবহার রোধে চিঠির সংখ্যা না বাড়িয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ মনিটরিং কমিটি গঠন করা জরুরি। যার সদস্য হতে পারে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের যুগ্মসচিব (প্রশাসন)। গাড়ি অপব্যবহার রোধে ওই কমিটি বিভিন্ন পন্থায় মনিটরিং করে তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও প্রতি মাসে একবার বৈঠক করে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট উপস্থাপন করতে পারে। সেখানে নিশ্চিত করা যাবে তাদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যেসব কর্মকর্তা গাড়ি প্রাধিকার সুবিধা নিয়েছে তারা কেউই সরকারের অন্য কোনো গাড়ি ব্যবহার করছে কিনা। পাশাপাশি পরিবহন পুলসহ প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি খাতে আগের তুলনায় ব্যয় হ্রাস বা বৃদ্ধি হয়েছে কিনা সে বিষয়েও পৃথক রিপোর্ট উপস্থাপন করা প্রয়োজন। কারণ সুদমুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ঋণ সুবিধা দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল সরকারের গাড়ি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় কমিয়ে আনা। পাশাপাশি উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে চাকরিজীবনে যেন ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে কোনো বাড়তি দুশ্চিন্তা করতে না হয়।
অন্যদিকে সচিবালয়ের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে, সরকারি গাড়ির অপব্যবহার রোধে শুদ্ধি অভিযান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেই শুরু হওয়া উচিত। তারপর অন্যান্য মন্ত্রণালয়েও তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা জরুরি। একজন ক্যাডার কর্মকর্তা যদি গাড়ি অপব্যবহারের লোভ সামাল দিতে না পারে তাহলে তার সামগ্রিক সেবা দেয়ার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তিনি কতোখানি পেশাদারিত্ব ও সততা বজায় রেখে সেবা দিতে পারছেন সেটি তখন জনমনে মৌলিক প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে। তাছাড়া এর সঙ্গে সরকারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির বিষয় তো থাকছেই। যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতেও উল্লেখ করা হয়েছে।