করোনা সুরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় দুর্নীতি এবং তালাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্ত প্রতিবেদন হীমাগারে রেখে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি দিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়। রেলসচিব তালাকাণ্ডের তিনজনকে বরখাস্ত করলেও মাস্ককেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদন হিমাগারেই রয়ে গেছে। সরকারি অর্থ লুটপাট কারিদের ফাইল সচিবের হেফাজতে রেখে হাসান মনসুরের অভিযোগ সংযুক্ত করে সেলিম রেজা গত বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদোন্নতির ফাইল উপস্থাপন করেন। মাস্ককাণ্ডে শাস্তির সুপারিশ করা শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের ফাইল পদোন্নতির নথিতে সংযুক্ত করা হয়নি। তাদের অভিযোগ অন্ধকারেই রয়েছে। শর্ষের ভিতরে ভূত থাকলে কি করবে রোঝা। এমনটাই অভিযোগ তুলেছেন রেলওয়ের সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারি।
গত ২৪ ডিসেম্বর সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে ২০২০ সালের ২১তম সভায় পদোন্নতির ফাইল প্রধানমন্ত্রী ২৬ সিসেম্বর সদয় অনুমোদন করেছেন। বিষয় উল্লেখ করা হয়, বিসিএস রেলওয়ে প্রকৌশল এবং বিসিএস পরিবহন ও বাণিজ্যিক উভয় ক্যাডারের কর্মকর্তা দ্বারা পূরণযোগ্য মহাব্যবস্থাপক পূর্ব,বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম, মহাব্যবস্থাপক পশ্চিম বাংলাদেশ রেলওয়ে রাজশাহী, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এমএন্ডসিপি)বাংলাদেশ রেলওয়ে,রেলভবন ঢাকা (গ্রেড-২) পদে পদোন্নতি। যাদের নাম দেয়া হয়েছে তারা হলেন,মো.হাসান মনসুর,প্রেষণে মহাব্যবস্থাপক,তার জন্ম ১৯৬৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর,অতিরিক্ত মহাপরিচালক আরএস মো.মঞ্জুর উল আলম চৌধুরীর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১জুন এবং পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক রাজশাহীর মিহির কান্তি গুহর জন্ম ১ জুন ১৯৬৩ সালে। প্রমর্জনার জন্য হাসান মনসুর এবং মঞ্জুর উল আলমের ফাইল মহামান্য রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
মাস্ককেলেঙ্কারি ঘটনা তদন্তে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমান পেয়েছে ইনভিষ্ট্রিগেশন টিম। তদন্ত সূত্র বলছে দেশের মানুষ যখন বেঁচে থাকার যুদ্ধে লড়াই করছেন। সে সময় রেলওয়ের কর্মকর্তারা করোনা সুরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ে সরকারের দেয়া ৪কোটি ৬৩ লাখ টাকা লুটপাটে লিপ্ত। ৩৯টি ঠিকাদার প্রতিষ্টানকে করোনা সুরক্ষা ক্রয়ে টেন্ডার দেওয়া হয়। গত বছরের এপ্রিল, মে মাসে করোনা মহামারি চরম আকার ধারণ করে দেশে। ওই সময় এসব সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা জুলাই মাসে করোনা সরঞ্জাম প্রদান করেছে বলে বিল ভাউচারে দেখানো হয়। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ৫৮ হাজার টাকা। যা বাজারমূল্যে রয়েছে তিন থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এ যেন সাগর ডাকাতির মত ঘটনা। তদন্ত দলের আহবায়ক জানান, তারা ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে আত্মসাত করা অর্থ জায়েজ করার চেষ্টা করেছে। জেরার মুখে তারা সদোত্তর দিতে পারেনি। এঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে বদলির সুপারিশ করে গত বছরের ৩ নভেম্বর কর্তৃপক্ষের কাছে
প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। দুর্নীতির এসব অভিযোগ হিমঘরে রেখে মো.সেলিম রেজা কারসাজি করে অন্যদের আড়াল করে শুধু হাসান মনসুরের অভিযোগ উপস্থাপন করেন পদোন্নতির জন্য। গত ২৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রায় সব শীর্ষ দুর্নীতিবাজকে পদোন্নতি দিয়েছে। জনপ্রশাসনের উপসচিব মো.আলতাব হোসেন ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর এই পদোন্নতির নথিতে সাক্ষর করেন।
মাস্ক কেলেঙ্কারি ঘটনায় প্রথমে নাম রয়েছে মঞ্জুর উল-আলম চৌধুরী এবং দুই নাম্বার এডিজি অপারেশন সরদার শাহাদত আলী। তদন্ত সুত্র। এঘটনা তদন্ত প্রতিবেদনে ২৯ জনকে বদলির সুপারিশ করেন যুগ্মসচিব ফয়জুর রহমান ফারুকী। রেল কর্তৃপক্ষ এসব শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের স্থানান্তর না করে স্বপদে বহাল রেখে পদোন্নতি পাইতে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন সচিব। এমনটাই অভিযোগ করছেন তদন্ত টিম এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে রাজশাহী বিভাগে তালা-বাঁশি কেনাকাটায় প্রায় ২৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৭ জনকে অভিযুক্ত করে সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত দলের আহবায়ক অতিরিক্ত সচিব ড. ভূবন চন্দ্র বিশ্বাস। রেলসচিব তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। তারা হলেন,পশ্চিমাঞ্চলের সাবেক সিসিএম এএমএম শাহনেওয়াজ, সিওএস মো.বেলাল হোসেন সরকার এবং এসিওএস মো. জাহিদ কাওছার। রেলসচিব মো.সেলিম রেজা গত ২৯ ডিসেম্বর তাদের বরখাস্ত করেন। সচিবের সাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে রেলওয়ে পণ্য ক্রয়ে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে তালাকাণ্ডের চেয়ে মাস্ককাণ্ড নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত ছিল এই ঘটনা। কর্তৃপক্ষের কাছে সেটা কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়? কিন্তু মাস্ক কেলেঙ্কারির অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তালাকাণ্ড ঘটনা তদন্তে রেলের অতিরিক্তি সচিব ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস,রেলওয়ের সাবেক উপসচিব মো.আব্দুর রহিম এবং পাকশীর ডিআরএম শাহিদুল ইসলাম। তদন্ত টিমের আহবায়ক জানান,গত বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। তিনি বলেন কর্তাব্যক্তিরা প্রতিবেদনের আলোকে যথাসময়ে ব্যবস্থা নেয়নি।
অন্যদিকে রেলওয়ের কর্তারা জানাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ যদি বর্তমান ডিজি মো.শামসুজ্জামানকে সময় বৃদ্ধি করে স্বপদে বহাল রাখে তাহলে রেল দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সে অভিযোগ দুদকে তদন্ত চলমান আছে। এসব ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পর কি স্বার্থে ডিজিকে ওই আসনে অধিষ্ঠিত রাখতে ইচ্ছুক কর্তৃপক্ষ। তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রেল অঙ্গনে।
রেল সচিব মো.সেলিম রেজা দায়িত্ব গ্রহণের পর কিছু চমক লাগানো কাজ করে প্রতিষ্ঠানের সকলের কাছে আস্তার জায়গা তৈরি করে নেন। কোরিয়া থেকে ২০০ কোচ ক্রয় প্রকল্পে টেন্ডারে প্রথম লোয়েস্ট দরদাতা (এসএসআরএসটি) সাংসিং রোলিং স্টক কোম্পানি। তার পরের দরদাতা দানোন সিস (Danonsys)। দুজনেই টেন্ডার পেতে মরিয়া। তাদের কর্মকাণ্ডে রেলকর্তৃপক্ষ না খোস হয়ে দীর্ঘদিন ওই ফাইল রেলমন্ত্রীর দপ্তরে পড়েছিল। বর্তমান রেল সচিব দায়িত্ব গ্রহণের পর বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ফাইল এনে সর্বনিম্ন দরদাতা সাংসিং রোলিং স্টক কোম্পানি (এসএসআরএসটি)কে কাজ দেন। এই কর্মদক্ষতাই তাঁর পুঁজি হয়। সচিবের চাকরি জীবনি তালাশ করে একই তথ্য পাওয়া গেছে। আর ওই দক্ষতাই সেলিম রেজার পথ চলার পুঁজি। তার বাস্তবতা কোরিয়ার দুইশ কোচ প্রকল্পের লোয়েস্ট কোম্পানিকে টেন্ডার দেওয়া। পদোন্নতি এবং দুর্নীতির বিষয়ে জানতে সাতদিন যাবত রেলসচিবের সাথে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেও দেখা মিলেনি। আজ রোববার সকাল ১১.৫২ মিনিটে সচিবকে ফোন দেয়া হয় তিনি রিসিভ করেননি। ১১.৪৮ মিনিটে এসএমএসের মাধ্যমে কয়েক দিন ধরে জবাব চাইলেও কোন উত্তর দেননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো.আলতাফ হোসেনের সঙ্গে সকাল ১১.৪৬ মিনিটে ফোনে এবং মেসেজের মাধ্যমে উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি কোন সারা দেননি। পরে বেলা সাড়ে ১২ টায় ফোন দিয়ে তিনি বলেন পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসিআর দেখা হয়। একপ্রশ্নের জবাবে বলেন, কর্তৃপক্ষ ফাইল পাঠান আমরা সাক্ষর করর দেই। তবে তিনি ওই ফাইল সই করার পর বদলি হয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে আছেন।