গত বছর থেকে শুরু হয়ে বিশে^ এখনও করোনার মহামারী চলছে। বাংলাদেশেও করোনায় প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে। আক্রান্তও হচ্ছে। করোনার প্রভাব ঠেকাতে গত বছর মহামারির শুরুতে সাধারণ ছুটিও ছিল। সেসময় বন্ধ ছিল গণপরিবহন। তারপরও গত বছর জুড়েই সড়ক দুঘটনা ছিল। করোনার মহামারি একদিন দূর হবে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কোনোদিন কমবে কি না সন্দেহ। এক তথ্যে দেখা যায়, দেশজুড়ে অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা এখন ২৪ লাখ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে হলে দক্ষ চালক তৈরির বিকল্প নই। আমাদের দেশে যারা মহাসড়কে বা অন্যান্য সড়কে যানবাহন চালায় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত। ফলে এ পেশায় শিক্ষিত মানুষের আগ্রহ তৈরি করতে হবে। পেশাটিকে একটি সম্মানজনক স্মার্ট পেশায় পরিণত করতে হবে। সেজন্য এই পেশায় জড়িতদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যবস্থা নিতে হবে। চাকরিতে নিশ্চয়তা থাকতে হবে। অনেক চালক গাড়ি চালানোর সঠিক সাইড, গতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়গুলো জানে না বললেই চলে। আবার জানলেও আইনের ফাঁক ফোকর খুঁজে তার মার প্যাঁচে ঠিক নিজেকে বের করে নেয়। দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই! সড়ক দুর্ঘটনা শব্দটি বর্তমানে আমাদের এত বেশী শুনতে হয় যে বিষয়টা খুব বেশিক্ষণ মাথার মধ্যে থাকে না। দুর্ঘটনা শব্দটি দিয়েই প্রতিটি ঘটনাকে দাড় করানো হচ্ছে। কিন্তু কতদিন? এভাবে দায়িত্বে অবহেলাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। লক্কড় ঝক্কর মার্কা গাড়ি রং চং করে সাজিয়ে আর কতকাল প্রাণঘাতী হয়ে মহাসড়কে চলবে। এই কাজটা করতে পারলে একদিকে যেমন রাজধানীতে গাড়ীর জট কিছুটা কমবে তেমনি দুর্ঘটনার পরিমাণও কমবে। প্রতিদিন এবেলা ওবেলা যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনার কথা আমাদের কানে তাতে কোন দুর্ঘটনার কথা কতক্ষণ মনে থাকবে। আমাদের অনুভূতিগুলো মনে হয় অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেছে। ইন্দ্রিয়গুলো এত সহজে আবেগে আক্রান্ত হয় না। কান্নার শক্তিও কমে গেছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বাস, ট্রাক, নসিমন-করিমন বা মটরসাইকেল বা কোন না কোন যানবাহন দুর্ঘটনায় পরবে। কখনো আলাদা আলাদা পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর খবর আসে আবার কখনো আসে একই পরিবারের সদস্যের মারা যাওয়ার খবর। ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতিতে মানুষের মৃত্যু আর আগের মত ভাবায় না। শুধু সাময়িক এক ধরনের যন্ত্রণা দেয়। যে যন্ত্রণায় মিশে থাকে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুজে না পাওয়ার ব্যার্থতার কথা। বারবার বহু আলোচনা, যুক্তি,তর্ক, বহু লেখালেখি বহু টকশো হয়েছে এই সড়ক দুর্ঘটনার উপর। কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে।
এসব কারণের মধ্যে রয়েছে ক্রটিপূর্ণ যানবাহন, চালকের অদক্ষতা (অনেক সময়ই দেখা যায় কয়েকনি চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করার পরপরই গাড়ি চালানোর মত ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব তুলে নেয়), ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি চালনা করা ( আমাদের দেশে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন রাস্তায় কত গতিতে গাড়ি চালানো উচিত সেসব নিয়ম কানুন মেনে চলার কোন বালাই নেই। যদিও সড়কের ধারেই সর্বোচ্চ গতির বিষয়টি লেখা থাকে), মহাসড়কগুলোতে আগে চালানোর প্রবণতা (সামনের গাড়ির চেয়ে আগে না গেলে যাত্রী পাওয়া যাবে না অথবা নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা অথবা অভ্যাসবশত অনেক চালকই এটা করে থাকে। জবাবদিহিতার অভাব, অনেক সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক বেশী থাকে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া অর্থ্যাৎ আইন জানা সত্তেও দেখা যায় তা মেনে চলার কোনই প্রয়োজন মনে করে না অনেকে, ড্রাইভিং পেশার অনুৎকর্ষতা, ক্রটিপূর্ণ ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা, বিকল্প যানবাহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং সবশেষে পথচারীর সচেতনার অভাবও রয়েছে প্রচুর।
আইন করা হয় নাগরিক সুরক্ষার জন্য। আর সে আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। আমি যদি মনে করি আমি না মানলে কিছুই হবে না অন্য সবাই মানবে। সেটা ভুল। কারণ আমাকে দিয়েই শুরু করতে হবে। নিজে মানতে হবে অন্যকে মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে কেন আইন মেনে রাস্তায় চলাচল করা উচিত। আমরা কেউই নিয়মের বাইরে যেতে পারি না। ঢাকা শহরে ওভারব্রীজ থাকতেও মারাত্বক ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছে প্রতিদিন। একটু এদিক সেদিক হলে যে রক্ষা নেই তাও কিন্তু জানি। এই কাজ যে ঠিক না এটাও কিন্তু জানি। কিন্তু মানি না। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর সাময়িকভাবে বোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় কাল থেকে এটা আর করবো না। কিন্তু কাল আসার পর আর মনে থাকে না। আবার সেই পুর্বদিনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করেই বাড়ি ফিরি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কিন্তু আমরা প্রায় সবাই জানি। সড়ক মহাসড়কে ক্রটি ও বিপদজনক মোড়গুলো কমিয়ে আনা, লাইসেন্সবিহীন সহকারীদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা, আইনের আধুনিকায়ন করা ইত্যাদি অনেক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেতে পারে। তবে সব কথার বড় কথা নিজেকে তৈরি করা। যাত্রী হিসেবে আমি যেমন রাস্তায় চলাচলের আইন মানতে বাধ্য ঠিক তেমনি একজন চালক হিসেবেও যেন কেউ আইন সঠিকভাবে মেনে চলে। উন্নত বিশ্ব যদি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন? দুর্ঘটনা ঘটার পর কার দোষ ছিল কার দোষ ছিল না এসব না ভেবে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেটা চিন্তা করাই ভাল। কারণ দুর্ঘটনা ঘটার পর সেই দায় আর কেউ নিতে চায় না। চালকদের প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। নতুন আইন দুর্ঘটনা রোধে কতটা সুফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইনের পাশাপাশি নিজেদের আইন মেনে চলার অভ্যাসটাও করতে হবে।
অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলাম লেখক