রেলপথ মন্ত্রণালয়ে রন্ধে রন্ধে অনিয়ম আর দুর্নীতি হয় বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। রেল বিভাগে দশটি সেক্টরে সরকারের অর্থ লুটপাট হওয়ার ঘটনা চিহ্নিত করেছে কমিশন। রেলপথ যেন এক দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে কমিশনের সংশ্লিষ্ঠ তদন্ত দল। রেলসেক্টরে ১০টি খাতে সরকারী অর্থ লুটপাটের মাহোৎসব বলে দুদকের তদন্ত প্রতিবদনে উটে এসেছে। আর এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে অসহায় রেলপথ মন্ত্রণালয়?
২০১৯ সালে দুদক কমিশনার ড.মোজাম্মেল হক খান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের হাতে রেলের দুর্নীতির ১০ উৎস তুলে দেন।
প্রথমত হলো:পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলের অধীনে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি লিজ ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি৷ জলাশয় লিজ দেয়া, রেলের জমিতে অবৈধ স্থাপনা, রেলের শত শত একর জমি বেহাত,লোকোমোটিভ, কোচ, ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ক্রয় ও সংগ্রহ, সিগনালিং ব্যবস্থার সংস্কার ও আধুনিকায়ন, ডাবল ও সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ কাজ, রেলের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, রেলের কারখানা সংস্কার, যন্ত্রাংশ বিক্রয় ও সংস্থাপন, ওয়ার্কশপ ও স্লিপার ফ্যাক্টরি কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি, রেলের কর্র্মকর্তাদের মাধ্যমে টিকিট বিক্রিতে ব্যাপক কালোবাজারি, যাত্রীবাহী ট্রেন ইজারা দেয়া এবং ট্রেনে নিম্নমানের খাবার দিয়ে বেশি দাম নেয়া।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,এখন রেল মন্ত্রণালয়ের কাজ হলে দুদকের এই প্রতিবেদন ধরে এবং সুপারিশ অনুসরণ করে দুর্নীতি বন্ধ ও দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া৷ তবে দুদকের দায়িত্ব এখানেই শেষ হয়ে যায় না৷ তারা রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান৷ তাদের এখন উচিত হবে দুর্নীতির সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা৷ আর দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, কমিশনের বর্তমান আইনে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির বিধান আছে৷ তবে এটা সাধারণভাবে রিকম্যান্ডেশন হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এর বেশি কিছু নয়৷ কিন্তু মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এটা ধরে দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া৷
দুদকের আরও কয়েক দফা সুপারিশ করেছে তার মধ্যে রেলওয়েকে স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল ব্যবস্থায় আনার কথা রয়েছে৷ এ ছাড়া নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত, ওয়ার্কশপ ও ফ্যাক্টরি সচল করা, ক্রয়, বিক্রয় ও টেন্ডারে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) অনুসরণ করা, রেলওয়ের সম্পদ রক্ষায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, অডিট জোরদার করা, রেলওয়ের সম্পদের জিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি, কোচ আমদানি না করে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে নির্মাণ, মনিটরিং ও তদারকি ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতিও রয়েছে৷
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, দুদকের এই প্রতিবেদন আমাদের মন্ত্রলণালয়ের ভবিষ্যৎ পথ চলায় সহায়তা করবে৷ যে দুর্নীতি করে সে কী বলে যে, আমি দুর্নীতি করি? তারা যে খাতের কথা বলেছেন সেই খাতগুলো দেখব৷ তাদের সুপারিশগুলোও বিবেচনা করবো৷ তবে তিনি জানান, ইতোমধ্যে বেশ কয়েক জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক কর্মকাতাদের বদলি এবং ওএসডি করা হয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, তারা যে ১০টি উৎসের কথা বলেছেন তার বাইরে কি দুর্নীতি হয় না? বিষয়গুলো নতুন নয়৷ আমাদের জানা৷ আমরাও কাজ করছিলাম৷ সব পর্যায়েই দুর্নীতি বন্ধ হোক সরকার এটা চায়৷ আমিও মন্ত্রী হিসেবে আমরা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে চাই৷
দুদকের এই প্রতিবেদনে দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত তা সুনির্দষ্ট করা হয়নি৷ আর কত টাকার দুর্নীতি বা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা-ও নির্দিষ্ট নয়৷
প্রতিবেদন উপস্থাপনকারী দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, আমরা দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলো দেখিয়ে দিয়েছি৷ এখানে আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও মন্ত্রণালয়ের নৈতিক দায়িত্ব হলো ব্যবস্থা নেয়া৷ বলতে পারেন আমরা সফট ভয়েসে জানিয়ে দিলাম৷ নয়তো এখনই আমাদের মামলায় যেতে হয়৷ আমাদের এই প্রতিবেদনে যদি কাজ না হয় তাহলে আমরা আরো সিরিয়াস হবো৷ তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ কগজপত্রসহ আমাদের কাছে আসে৷ আমরা আমাদের মতো করে আইন অনুযায়ী সেই অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিব। দুদকের এক পরিচালক বলেন,করোনা সুরক্ষা ক্রয়ের অভিযোগ দুদক অনুসন্ধান করছে। কিছু নথিপত্র কমিশনের হাতে রয়েছে। এছাড়া, রেলওয়ের কয়েকটি অভিযোগ অনুসন্ধানাধিন আছে। রেল মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা না নিলে কমিশন মামলা করবে। তিনি জানান, দুদক প্রধান কার্যালয়, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে রেলওয়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সকল অভিযোগের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ আছে। কমিশন অনুমোদন দিলেই মামলা করা হবে। দুদক কমিশনার মো,মোজাম্মেল হক খানের সাথে বেলা ২.৫০ মিনিটে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত থাকায় কোন মন্তব্য করেননি। রেলসচিব মো.সেলিম রেজার সাথে ২ঘন্টা অপেক্ষা করেও দেখা মেলেনি। সচিবের পিএস মাহবুবুল হক নামের চিরকুট পাঠানোর পরই মন্ত্রীর রুমে প্রবেশ করেন সচিব। অপেক্ষার প্রহর গুণেও দেখা মিলেনি।