পরিবারতন্ত্র- স্বৈরতন্ত্র-দুর্নীতি যখন এসে ভর করেছে ছাত্র-যুব-জনতার মেলবন্ধনের দেশে। যখন নির্মমতার রাজনীতির কারণে নির্মমভাবে বাংলাদেশ সমুদ্রবেদনায় অগ্রসর হচ্ছে, তখন কেবলই বলতে ইচ্ছে করছে-
আসাদ তোমার রক্ত দিয়ে বাণিজ্যটা চলছে বেশ
জীবন দিলে তুমি যদিও অন্ধকারে বাংলাদেশ
উত্তরণে নতুনধারার নতুন সবাই জাগুন
নতুন করে দেশ গড়তে স্বার্থতে দিন আগুন
দেশের জন্য ভাবতে থাকুন দেশের জন্য লড়–ন
বীর যোদ্ধার দেশটা আবার নতুন করে গড়–ন
নিশ্চিত হোক ভোটাধিকার, নিশ্চিত হোক খাবার
প্রয়োজনে আসাদ হবো আমরা সবাই আবার...
সারাদেশে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-জঙ্গীবাদ-দুর্নীতির চলমান অবস্থা দেখে কেবলই মনে পড়ে রাজপথে জীবনদানকারী শহীদ আসাদ-এর কথা। অবিনাশী সাহসের হাত ধরে রাজপথে যারা থাকে, তারা সবাইকে ডাকে আলোর পথে। যেমন করে ডেকেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। তেমন করে তাঁর মত করে রাজপথে লড়াই করার জন্য এখন আর কেউ যেন অবশিষ্ট নেই; যে কারনে নির্মমতার অন্ধকারে ঢেকে যায় আমাদের মানচিত্র, আমাদের বাংলাদেশ।
ইতিহাস বলে- অগণতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা পাক সরকারের বিরুদ্ধে একজন নিবেদিত দেশপ্রেমিক শহীদ আসাদ-এর জীবনদানে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়। এরপর নানা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। আসাদ ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ বিপ্লবী নেতা। তিনি একাধারে যেমন ছাত্র আন্দোলন করতেন তেমনি কৃষক আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর মওলানা ভাষানী যে হাট হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। নিজ বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদি থেকে সেই হাট হরতালে অংশগ্রহণ করেছিলেন আসাদ। এবং এ কারণে তিনি পুলিশ হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহতও হয়েছিলেন। পরে তিনি মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই ঢাকায় এই খবরটি দিতে আসেন। তার কিছুদিন পরেই নিজে গুলিবিদ্ধ হয়ে আসলেন। সেই সময় দৈনিক পাকিস্তানে নির্মল সেন লিখেছিলেন - আসাদ এসেছিল খবর দিতে আর আসাদ আজকে এলো খবর হয়ে।
ইতিহাসের আয়নায় চোখ রেখে জানতে পারি- ১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ছাত্রদের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করে ছাত্র সংগঠনের নেতারা। সেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন আসাদ। পরে ১৭ই জানুয়ারি ছাত্রনেতারা দেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য ১৪৪ ধারা আইন জারি করেন।
এর ৩ দিন পর রাজপথে ছাত্ররা আন্দোলনে নামলে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন ছাত্রনেতা আসাদ। এর পর আসাদের সেই রক্তমাখা শার্ট যেন হয়ে উঠেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। শহীদ আসাদের মৃত্যুর পরই প্রতিবাদী মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার নামে ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথে। সংঘটিত হয় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সংঘটিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল জয়ের মধ্য দিয়ে পতন হয় পাকিস্তানের। ইতিহাসের যুগান্তকারী এই দিনে আজ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হবে শহীদ আসাদকে। কিন্তু তাঁর জীবনদানের বিনিময়ে আজ কি আমরা রাজপথে-কাজপথে অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছি? প্রশ্নের উত্তরটা যখন ‘না’। তখন নিদারুণ বেদনায় কানে ভেসে আসে সেই সংগ্রামী মানুষের রাজপথে জীবন দিয়ে এগিয়ে চলার প্রেরণা নিয়ে বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান-এর ‘আসাদের শার্ট’-এর সাহসী উচ্চারণ। যেখানে কবি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আসাদকে কৃতজ্ঞতায় লিখেছেন-
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে ।
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায় ।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা ।
ছাত্রনেতা আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা হল শাখার সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুব খান সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে চানখাঁরপুলে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি। তিনি যেই ইউনিয়ন করে রাজপথে জীবন দেয়ার উদাহরণ নির্মাণ করেছেন, সেই ইউনিয়ন-এর নেতাকর্মীরা যখন নিজেদের রাজপথের ইতিহাস ভুলে লোভ-মোহের ফাঁদে পড়ে রাজপথকে কলুষিত করে তখন খুব বলতে ইচ্ছে করে-
রাজপথে না থাকবে যদি প্রতারণা করো না
যেই পথে তুমি লক্ষ্য রাখো না সেই পথ ধরো না।
আসাদ শহীদ হওয়ার পর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্রদের ১১ দফার ভিত্তিতে সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলনে সংঘটিত হয় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। পতন ঘটে আইয়ুব খানের। আরেক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ১৯৭০ সালের সেই অভূতপূর্ব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়; কিন্তু ইয়াহিয়া ক্ষমতা না ছাড়ার জন্য নানা টালবাহানা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তর সালে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
আসাদ ছিলেন অসম্ভব সাহসী এক নেতা। অনেকবার তাঁর সাহস ও বীরত্বের সাক্ষাৎ পেয়েছি আমরা। শহীদ আসাদের আত্মত্যাগকে ‘স্বাধীনতাসংগ্রামের সিঁড়ি’ হিসেবে যারা অবহিত করেছেন বিভিন্ন সময়; তারাই ভুলে গেছেন, আসাদের মৃত্যুর পরই যেন নতুন শক্তিতে জেগে উঠেছিল গোটা দেশ। তাঁর রক্তদানই আইয়ুব শাহির পতনের পথ তৈরি করে। এর পরই গণ-অভ্যুত্থানের পথ ধরেই স্বাধীনতাসংগ্রাম তরান্বিত হয়।
শুধু ভুলে গিয়েই ক্ষান্ত হননি; নিজেদের আখের গুছিয়েছেন শহীদ আসাদ-এর রক্তের বাণিজ্য করে; কেউ কেউ তো নিজেরা সংসদ সদস্য হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেনই; স্ত্রী-সন্তানকেও অভিজ্ঞতা না থাকা স্বত্বেও সংসদ সদস্য করে প্রমাণ করেছেন, শহীদ আসাদ কেবল তাদের উপরে ওঠার সিঁড়ি ছিলো; আদর্শ নয়- প্রেরণাও নয়।
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি