দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩১ কিলোমিটার দুরে বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামের মতো প্রত্যন্ত একটি গ্রাম মধ্যপাড়া। সেই গ্রামটিই আজ নিজ পরিচয়ে দেশ বিদেশে পরিচিত। কেন না সেখানে রয়েছে দেশের একমাত্র এবং বৃহৎ উৎপাদনশীল মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি। বাংলাদেশের খনিজ সম্পদে সম্বৃদ্ধ পার্বতীপুর উপজেলার একটি সুনামধন্য এলাকা এই হরিরামপুর ইউনিয়নের মধ্যপাড়া। ৩ হাজার ৮৮৮ বর্গ কিলোমটিার আয়তনের এই ইউনিয়নে রয়েছে ১৪টি গ্রাম। প্রত্যন্ত এই জনপদে কঠিন শিলা খনির কারনে আজ এখানকার অর্থনীতি অন্য গ্রমীন জনপদ থেকে উন্নত। ২০০৭ সালে খনি থেকে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। আশায় বুক বাধে খনি এলাকাবাসী। এই খনিতে বেকারদের হবে কর্মসংস্থান। পাল্টে যাবে এই জনপদের অর্থনীতির চেহারা। কিন্তু সেই স্বপ্ন তাদের স্বপ্নই রয়ে যায়। দীর্ঘ ৬টি বছর এই খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা খনিটি শত কোটি টাকার উপরে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে বন্ধের উপক্রম হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশের সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন মুলক কর্মকান্ডে মধ্যপাড়ার উন্নত শিলা ব্যবহার বাড়াতে ২০১৩ সালে খনিটির দায়িত্ব তুলে দেন দেশীয় একমাত্র মাইনিং কোম্পানী জার্মানীয়া কর্পোরেশন লিমিটেড ও বেলারুশ কোম্পানী ট্রেস্ট এস এস এর যৌথ প্রতিষ্ঠান জার্মানীয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) এর হাতে। সরকারের এই লোকসানী প্রতিষ্টানটিকে লাভের দিকে নিয়ে যেতে দায়িত্ব গ্রহনের শুরু থেকেই জিটিসি খনির উৎপাদন এবং উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে খনির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী তিন শিফট চালু করে এই খনির পাথর উৎপাদন ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে। ফলে পাথর খনিটি দুই অর্থ বছরের লাভের মুখ দেখেছে। খনিটি এখন সরকারের লাভজনক প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিটিসি খনির পাথর উৎপাদন ও উন্নয়ন এর পাশাপাশি খনির সন্মুখে ‘চ্যারিটি হোম’ স্থাপন করে বিভিন্ন সামাজিক কল্যানমূলক কর্মকান্ড এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ সেবা দিয়ে এলাকাবাসীদের পাশে দাড়িয়ে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। এলাকার মানুষ বলছে ইতিপূর্বে এই খনি এলাকাবাসীর জন্য এমন সামাজিক কর্মকান্ড নিয়ে এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কেউ তাদের পাশে দাড়ায়নি। জিটিসি’র এই সেবা মূলক কর্মকান্ড একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলোর জন্য এক দৃষ্টান্ত হতে পারে। মধ্যপাড়া পাথর খনির খনির উন্নয়ন ও উৎপাদন কাজে নিয়োজিত জার্মানীয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) পাথর খনির উন্নয়ন ও উৎপাদন করে খনির ইতিহাসে নয়া রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। খনি কার্যক্রমের পাশাপাশি খনির এলাকাবাসীদের জন্য সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে খনি সন্মুখে সমাজকল্যান সংস্থা “জিটিসি চ্যারিটি হোম” স্থাপন করা হয়েছে। চ্যারিটি হোমে একজন অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার দ্বারা প্রতিদিন খনি এলাকার ৪০/৫০ জন রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সেই সাথে প্রতি মাসে খনি শ্রমিকদের উচ্চ শিক্ষায় অধ্যায়নরত সন্তানদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তি, নন এমপিভুক্ত মধ্যপাড়া মহাবিদ্যালয়কে মাসিক আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আর্থিক ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে জিটিসি।
গতকাল মঙ্গলবাল বিকেলে ‘জিটিসি চ্যারিটি হোমে’ এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় ১০ কিলোমিটার দুর পাচঁপুকুর গ্রাম থেকে ডাক্তার দেখাতে আসা ৭০ বছর বয়সী বিধবা বৃদ্ধা মোছাঃ সফিরন বেওয়ার সাথে। তিনি বলেন, মুই অনেকদিন থেকে অসুখে ভুগছো, সরকারী হাসপাতাল মেলা দুর। যাবারও পারো না। মানষের কাছে শুননু এই খনির জিটিসি নাকি এটি একটা বড় ডাক্তার বসাইছে হামার এলাকার মানুষের চিকিৎসা দিবার তনে। তাই আইছু বাবা। ডাক্তার মোক দেখলো। ঔষুধ দিল। মনে হছে এবার অসুখ ভালো হবে মোর। আল্লাহ জিটিসি’র ভালো করুক।
‘জিটিসি চ্যারিটি হোমে’ চিকিৎসা নিয়েছেন খনি এলাকার পাইকাড়পাড়া গ্রামের অমিতা খাতুন (৭০)। তিনি জানান, আমি কাশিঁ ও সর্দি নিয়ে চ্যারিটি হোমে ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার আন্তরিকতার সাথে আমার সমস্যার কথা শুনেছেন। তার পর ঔষুধ দিয়েছেন। সেই ঔষুধেই আমি সুস্থ্য হয়েছি। দ্বিতীয় বার আর যেতে হয়নি।
দীর্ঘ দিন ধরে গায়ে ব্যথা ও প্র¯্রাবের সমস্যা নিয়ে খনি এলাকার শাহাৎত হোসেন (৭৫) দেড় মাস আগে জিটিসি’র চ্যারিটি হোমে এসে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়েছেন। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি লোকমুখে শুনে জিটিসি চ্যারিটি হোমে এসে ডাক্তার দেখিয়ে ঔষুধ খেয়ে সুস্থ্য হয়েছে। তিনি এমন ভালো কাজের জন্য জিটিসকে ধন্যবাদ জানান।
চ্যারিটি হোমে শিক্ষা উপবৃত্তি গ্রহন করতে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থী মোছাঃ আখিঁ আহম্মেদ বলেন, আমার বাবা প্রায় ২০ বছর ধরে এই খনিতে চাকুরী করেন। ইতিপুর্বে খনি শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে জিটিসি’র মত এমন করে কেউ কখনো ভাবেনি। আমাদেরকে প্রতিমাসে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করে উচ্চ শিক্ষায় সহযোগিতা করায় তিনি জিটিসি কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
অপর, শিক্ষার্থী ফিরোজ মাহমুদ শুভ বলেন, জিটিসি খনি শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা উপবৃত্তি দিয়ে লেখাপড়ায় উৎসাহিত করেছেন। এছাড়া জিটিসি চ্যারিটি হোম প্রতিষ্ঠা করে অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে খনি শ্রমিকদের পরিবারের পাশাপাশি এলাকার মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ সেবা প্রদান করছে। এ সকল কর্মকান্ড নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
মধ্যপাড়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মোঃ ওবায়দুর রহমান বলেন, কলেজটি এমপিও ভুক্ত না হওয়ায় তাদের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারী কোন প্রকার বেতন ভাতা পান না। শিক্ষকদের এমন দূর্দশায় জিটিসি প্রতিমাসে আর্থিক ভাবে তাদের সহায়তা করে পাশে দাড়ানোর জন্য তিনি জিটিসি কর্তপক্ষকে বিশেষ করে নির্বাহী পরিচালক জনাব জাবেদ সিদ্দিকীকে ধন্যবাদ জানান।
১০নং হরিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মাসুদুর রহমান শাহ বলেন, গ্রমীন এই জনপদে স্বাস্থ্য সেবা নিতে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দুরে উপজেলা সদর হাসপাতাল এবং ১৫ কিলোমিটার দুরে ফুলবাড়ী হাসপাতালে যেতে হয়। জিটিসি চ্যারিটি হোম স্থাপনের মাধ্যমে সামাজিক কল্যানমূলক কাজের পাশাপাশি অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার দ্বারা এলাকার গণমানুষের স্বাস্থ্য সেবায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ সেবা দিয়ে যে অবদান রাখছে তা নজিরবিহীন।
পাথর খনি লোড-আন লোড কুলি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সাদেকুল ইসলাম বলেন, জিটিসি যে ভাবে পাথর উত্তোলন করেছে ইতিপুর্বে এমনভাবে কেউ এই খনি থেকে পাথর উত্তোলন করতে পারেনি। জিটিসিই পাথর খনিটিকে লাভজনক করেছে। আবার খনি এলাকাবাসীর জন্য জিটিসি চ্যারিটি হোম স্থাপন করে সেখান থেকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ সেবা দিচ্ছে। এতে করে এলাকাবাসী খুশী। এমন কাজের জন্য জিটিসিকে ধন্যবাদ জানান তারা। কেননা আমাদের পাশেই কয়লা খনি রয়েছে। সেখানে খনি এলাকাবাসীর জন্য এমন কোন সামজিক কার্যক্রম নেই।
জিটিসি চ্যারিটি হোম নিয়ে কথা হয় জার্মানীয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)’র নির্বাহী পরিচালক মোঃ জাবেদ সিদ্দিকীর সাথে তিনি জানান, এই খনির জন্য এলাকাবাসীর অনেক ত্যাগ এবং অবদান রয়েছে। খনি এলাকার মানুষ এতদিন এই খনিটিকে লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখেেেছ। বর্তমানে জিটিসি’র হাত ধরে পাথর খনি পর পর দু’বছর লাভের মুখ দেখেছে। এলাকাবাসীর এই খনি নিয়ে প্রত্যাশা অনেক। আমরা তাদের প্রত্যাশা বিবেচনায় এই খনির উন্নয়নের সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমার কোম্পানী খনি শ্রমিকদের উচ্চ শিক্ষায় অধ্যায়ররত সন্তানদের শিক্ষা উপবৃত্তি, এলাকাবাসীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক কল্যানমূলক কর্মকান্ডে তাদের পাশে দাড়ানোর জন্য একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জিটিসি চ্যারিটি হোম প্রতিষ্ঠা করেছে। সামাজিক এই কাজে তিনি খনি এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করেছেন।