দেশে অর্থ পাচার সংক্রান্ত বহু মামলা চলমান। এসব মামলার বেশিরভাগেরই তদন্ত করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। তদন্ত দ্রুত শেষ না-হওয়ার পেছনে তদন্ত কর্মকর্তার দক্ষতার অভাব দায়ী বলে জানা গেছে। দেখা গেছে, দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তার অভাবে তদন্তে বিলম্ব ঘটায়। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী-না নিরপরাধ, তা প্রমাণের আগেই সংশ্লিষ্টদের ব্যবসায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে; এমনকি অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, যা মোটেই কাম্য নয়। দেশে অর্থ পাচার সংক্রান্ত অসংখ্য মামলা দীর্ঘদিন তদন্তাধীন। যথাসময়ে এসব মামলার তদন্ত শেষ করা গেলে নিঃসন্দেহে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি নিরপরাধ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিড়ম্বনা এড়ানো যেত। কাজেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আগে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা তদন্তের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর। ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশের পর থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন ছাড়াও অন্য ৪টি সংস্থা এ-সংক্রান্ত মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায়। এগুলো হলো- পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। অতিরিক্ত ৪টি সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রত্যাশা ছিল, অর্থ পাচার সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রমে গতি আসবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রায় কিছুই পরিলক্ষিত হচ্ছে না-যা অনভিপ্রেত।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদেশে অর্থ পাচার অন্যতম প্রতিবন্ধক-এতে কোনো সন্দেহ নেই। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ‘ডেলিভারিং এসডিজি ইন বাংলাদেশ : রোল অব নন-স্টেট অ্যাকটরস’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসডিজির ৪ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি শীর্ষক বইয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে বলা হয়েছিল, দেশ থেকে প্রতিবছর নানাভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ ১৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার (এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা) ছাড়িয়ে যেতে পারে। অর্থ পাচারের এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির সফল বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিদেশে অর্থ পাচার গুরুতর অপরাধ। এজন্য শাস্তির বিধান রেখে আইনও করা হয়েছে। তারপরও টাকা পাচারের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না কেন-এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
আইনগতভাবে দেশের বাইরে টাকা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ না-থাকলেও গত দেড় দশকে অনেকেই মালয়েশিয়া, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই প্রভৃতি দেশে বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য ব্যবসায়-বাণিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। বহুল আলোচিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসেও অনেক বাংলাদেশির নাম অন্তর্ভুক্ত থাকার সংবাদ ইতঃপূর্বে গণমাধ্যমে এসেছে। মনে রাখতে হবে, অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে মূলত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টির প্রেক্ষিতে। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, দেশে সঞ্চয় বাড়লেও বিনিয়োগ বাড়ছে না। টাকা পাচারের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারের হারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে টাকা পাচারের ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আর তাই প্রয়োজন অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। এজন্য অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণের বিষয়টি জরুরি। কাজেই অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণের অন্যতম অনুষঙ্গ তদন্ত কার্যক্রমে ধীরগতি পরিহারের লক্ষ্যে তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া উচিত।