ভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার বিষ্ফরোন ঘটলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই মূলত রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক শুরু হয়। মুসলিম লীগ সরকার উর্দূ ভাষাকে সুকৌশলে বাঙ্গালিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দূ ও ইংরেজীর সাথে বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি তোলেন। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দ বাজার পত্রিকা ও ২৭ ফেব্রুয়ারি অমৃত বাজার পত্রিকা এখবর প্রকাশ করে। কয়েকটা পত্রিকা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদে ‘ইনসাফ’, ‘জিন্দেগী’ ও ‘দেশের দাবী’ পত্রিকা থেকে তিন জন করে প্রতিনিধি নেয়া হয়।
পাকিস্তানিরা আরবি হরফে বাংলা লিখার মত হাস্যস্পদ চিন্তাই শুধু করেনি বরং তা বাস্তবায়নে উদ্যোগও নিয়েছিল। কিন্তু এ দেশের সচেতন ছাত্র সমাজ তাদের মাতৃভাষার এ অপমান মুখ বুঝে সহ্য করে নি। তারা প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ফেটে পড়ে। বুকের তপ্তরক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে ভাষার মান রক্ষা করেছে। ভাষার আন্দোলনের সূচনা কালে ১৯৪৭ সালের ২২ জুন কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার বরিবাসরীয় বিভাগে ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবনা’ শিরোনামে লেখক সাংবাদিক আব্দুল হকের একটি প্রবন্ধের প্রথম অংশ ছাপা হয়। দ্বিতীয় অংশটি ছাপা হয় ২৯ জুন। বাংলার ভাষাগত স্বাতন্ত্র সম্পর্কে প্রবন্ধে বলা হয়, ‘আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজী-উর্দূ-হিন্দি বলতে বাধ্য থাকবে? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেইসব ইংরেজ বা উর্দূ-হিন্দিভাষীরা কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে? আমার মত এই যে, এ দেশে যেসব ভারতীয় অথবা অবাঙ্গালী বাস করবে তাদের বাংলা শিখতে হবে, যদি তারা এ দেশে বাস করতে চায় এবং আমাদের সাথে চলতে চায়। বাংলা শিক্ষা তাদের গরজ। তাদের জন্য ইংরেজী বা উর্দূ-হিন্দি শেখা আমাদের গরজ নয়, বরং আমাদের পক্ষে ঘোর অমার্যদাকর।’
বাংলা ভাষা সংগ্রামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ সহ পূর্ব বাংলার বেশ কিছু দৈনিক বাংলা ভাষা সংশ্লিষ্ট সংবাদ, প্রতিবেদন, নিবন্ধ, উপ-সম্প্রদকীয়, কবিতা, গান, কার্টুন ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক জনমত ঘটাতে থাকে। তবে দৈনিকের চেয়ে সেময়ের সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর তির্যক আলোচনা জনগনের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। আজকে দৈনিক ইত্তেফাক সে সময়ের সাপ্তাহিক হিসাবে প্রকাশিত হত। সম্পাদক ছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। পৃষ্টপোষক ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী। মুদ্রাক্ষর ও প্রকাশক ছিলেন ঢাকার কারকুনবাড়ি লেনের ইয়ার মোহাম্মদ খান। সাপ্তাহিকটি ছাপা হত ৯ হাটখোলা রোডের প্যারামাউন্ট প্রেস থেকে। ১৯৫২ সালে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলী ইত্তেফাক প্রথম পৃষ্টায় বেশ গুরুত্বের সাথে ছাপে। যার শিরোনাম ছিলো, ‘দেশের কাছে লাল ফেব্রুয়ারির শহীদদের ডাক আসিয়াছে।’ ‘বাংলা ভাষার সংগ্রামকে সফল করিয়া রক্তের প্রতিশোধ নাও।’ ‘নুরুল আমিন ও প্রতিশ্রুতির পিচ্ছিল পথে পা বাড়াইয়াছেন। জনগন হইতে বিচ্ছিন্ন সরকার আজ মিলিটারির জোরে বাঁচিয়া আছে’। ১৯৫২ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশ্য গণআদালতে প্রাদেশিক সরকারের বিচার দাবি করে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘... মুসলিম লীগ সরকার তার অতীতের সব কুকীর্তিকে ম্লান করিয়াছে ... আহত ছাত্র ও শিশুর ক্রন্দনে ঢাকার আকাশ বাতাস মুখরিত। ছেলে হারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে জনতাকে আকুল করিয়াছে। আজ পাকভূমির পাক রাজধানী এক শ্মশানে পতিত ... তাই সরকারের এই বর্বরতার ক্রমবর্ধমান ব্যাপকতার সর্বত্রই আজ বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ জাগিয়া উঠিয়াছে ... কেন তারা নিরীহ ছাত্র ও পথচারীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চালাইয়া কতগুলো মূল্যবান জীবন নাশ করিল... তাই দেশের অযুত কন্ঠের সঙ্গে কন্ঠ মিলাইয়া আমাদের ঘোষণা শুধু ছাত্র জনতার ঘাতক সরকারি কর্মচারীদের নয়, এ জঘন্য হত্যাকান্ডের হোতা সরকারের বিচার চাই প্রকাশ্য গণ আদালতে। শুধু ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি নয়, পরবর্তীতে বাঙ্গালির স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনেই ইত্তেফাক জনতার কন্ঠস্বর হয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫৩ সালে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ইত্তেফাক সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক হিসাবে প্রকাশ হতে শুরু করে।
এদিকে সাপ্তাহিক সৈনিক প্রকাশনার শুরু থেকেই বাংলা ভাষার পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। পত্রিকাটি প্রকাশ হয় ১৪ নভেম্বর ১৯৪৮ (২৮ কার্তিক ১৩৫৫)। এ পত্রিকার সাংবাদিকরা ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থেকেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র জনতার ওপর পুলিশের গুলি বর্ষণ ও কয়েকজন শহীদ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সৈনিক-এর শহীদ সংখ্যা। লাল কালিতে ও লাল বর্ডার দিয়ে প্রকাশিত এই সংখ্যার উল্লেখযোগ্য শিরোনাম ছিল, ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে, রজাধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলি বর্ষন। গত বৃহস্পতিবার ৭ জন নিহত, ৩ শতাধিক আহত, ৬২ জন গ্রেফতার, শুক্রবারেও ব্যাপক সংখ্যক লোক হতাহত, রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা করার শপথ বিঘোষিত।’ সাপ্তাহিক সৈনিকের এ সংখ্যাটি দারুণ ভাবে লুফে নেয় পাঠক জনতা। তাদের চাহিদা মেটাতে পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে এ সংখ্যাটির তিনটি সংস্কারণ করতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে। সাপ্তাহিক দৈনিকের সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি ছিলেন শাহেদ আলী। পরবর্তিতে আব্দুল গফুর। প্রকাশিত হতো ১৯ আজিমপুর রোড, ঢাকা থেকে। তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ও খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, ‘উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিবার চক্রান্তকে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। নজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রদেশ ব্যাপী বিক্ষোভ। নাজিমদ্দিনের বিবৃতির প্রতিবাদ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের ঢাকা কেন্দ্রের আহবায়ক মি. মাহফুজুল হক ও বিশ^ বিদ্যালয়ের তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক মি. শাহাবুদ্দীন খালেক সংবাদ পত্রে যে বিবৃতি দেন তাও সৈনিকে প্রকাশিত হয়।
সাময়ীকির মধ্যে ঢাকা থেকে মাসিক অগত্যা ভাষার তাত্ত্বিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে নান্দনিকভাবে পাঠক প্রিয়তালাভ করে। ১৯৪৯ সালে ১০৭ ইসলামপুর থেকে ফজলে লোহানীর সম্পাদনায় প্রকাশ হয়। ছাপা হতো পুরোনা ঢাকার রমাকান্ত নন্দী লেনের পাইওনিয়ার প্রেস থেকে। অগত্যার লক্ষ্য করার মত বৈশিষ্ট ছিল কায়দে আজম বা মহাকবি ইকবালের কোনো স্তুতি না করে রবীন্দ্রনাথের উক্তি পুরাভাগে উদ্ধৃত করে বা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধ (পৃথিবীর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ছেপে যাত্রা শুরু করেছিল। সোভিয়েত সাহিত্যিক আনন্ত শেকভ সম্পর্কে আলোচনা ও মার্কসীয় মতাদর্শ বিশ^াসী সাহিত্যিক খাজা আহমদ আব্বাসের রচনার অনুবাদ এতে গুরুত্বসহ ছাপা হয়। প্রথম থেকে শেষ পান্ত ইলিয়া ইলিয়া ইলেমবুর্গ, এ্যালান মবর, আসাতোল ফ্রান্স, বালজাক, বার্নাড’শ, হেসিংওয়ে, এগ্রিনিন, গোর্কি প্রমুখ ও বিদেশী প্রগতিপন্থী লেখকের সাহিত্যের অনুবাদ অগত্যায় বিশেষ মর্যাদায় ছাপা হতো। বিদেশী সেরা সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ প্রগতিবাদী চিন্তাধারার সাথে বাঙ্গালি পাঠকদের পরিচয় করিয়া দিয়ে সাহিত্যিক পরিমন্ডলে অগত্যা নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিল। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের সময়কালে বিদ্রুপাত্মক এবং তীব্র সমালোচনামুলক ভাষায়, মাসিক, অগত্যা, অবাঙালি ও উর্দূ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত তথা সামগ্রীক ভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বপক্ষে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। নিদারুন অর্থ কষ্টে পত্রিকাটি ১৯৫২ সালের মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যান্য পত্রিকার মধ্যে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে ঢাকা থেকে প্রকাশিত নতুন দিন, সম্পাদক খন্দকার আব্দুল কাদের, ফেনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংগ্রাম, সম্পাদক খাজা আহমেদ, চট্রগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সীমান্ত। সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘নওবেলাল’ সম্পাদক মাহমুদ আলী। ধর্মের জিকির তুলে এবং পাকিস্তানের অখন্ডতার দোহাই দিয়ে যে সব বাংলা মাসিক পত্রিকা ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধীতা করেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদীত মাসিক মোহাম্মদী। এরপরই সরকারি মালিকানার মাসিক ‘মাহে নও’ এর সম্পাদক ছিলেন কমরেড মুজ্জাফর আহমেদের জামাতা কবি আব্দুল কাদের। এ ছাড়া মাসিক ‘দিলরুবা’ ও মাসিক ‘নওবাহার’ পত্রিকার ভূমিকা ছিল দারুন প্রতিক্রিয়াশীল। ‘নওবাহার’ পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফার সহধর্মিনী মাহফুজা খাতুন, মাসিক দিলরুবা পত্রিকাটি ছিল উর্দূ ভাষার সমর্থক।
ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সংবাদ পত্র শুধু জনমত গঠনেই অবদান রাখি নি। বরং সংবাদপত্র সংশ্লিষ্টরা এদেশের গনমানুষের অধিকার আদায়ের স্বপক্ষে লড়েছেন। দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ও সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল’ সম্পাদক মাহমুদ আলী ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষনের প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হতে পদত্যাগ করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনা করেন। ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইনসাফ ও দৈনিক আমার দেশ। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার মিল্লাত ব্যানার শিরোনাম করে ‘রাতের আঁধারে এত লাশ যায় কোথায়?’ ঘটনার পর মিল্লাত সম্পাদক মো: মোদাব্বেরের নামে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারি হয়।
দেশ ভাগের আগে ভাষার প্রশ্নে দৈনিক আজাদে বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও এ ব্যাপারে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি শুরু থেকেই ছিল রহস্যেঘেরা। আজাদে কখনো বাংলা ভাষার পক্ষে আবার কখনো বিপক্ষে বক্তব্য প্রকাশ হতে দেখা যায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ভাষার প্রশ্নে পত্রিকাটির কোন সুনিদিষ্ট অবস্থান ছিল না। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি বর্ষনের ঘটনার পর ভাষার প্রশ্নে আগের রহস্যের জাল ছিন্ন করে দৈনিক আজাদ। এ দিন সন্ধ্যায় আজাদ প্রকাশ করে বিশেষ টেলিগ্রাম। ব্যানার শিরোনামে বলা হয় ‘ছাত্রদের তাজাখুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত।’ মুসলিম লীগ সরকার দৈনিক আজাদের এ সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করে। পুলিশের গুলি বর্ষনের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরবর্তী কয়েক দিন দৈনিক আজাদ প্রচুর সংখ্যা ছেপে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সোচ্ছার ভূমিকা রাখে।
মনিং নিউজ ছিল উর্দূ ভাষার সমর্থক। পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উগ্র প্রচারনা চালায়। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকেও বিকৃত করে ২২ ফেব্রুয়ারি খবর প্রকাশ করলে বিক্ষুদ্ধ জনতা ভিক্টোরিয়া পার্কের (বাহাদুর শাহ্ পার্ক) কাছে অবস্থিত মনিং নিউজ প্রেস ও অফিস জ¦ালিয়ে দেয়। ভাষা প্রেমিক জনতার ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই জায় মনিং নিউজ। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিকই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সমর্থক। কিন্তু মালিকদের কারণে পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরোধীতা করেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি খবরও পত্রিকাটি খুব কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ক্ষুদ্ধ জনতা হাটখোলা রোডে সংবাদ অফিসে হামলা চালায়। ভাষা আন্দোলনে বিরোধী ভূমিকার জন্য পত্রিকাটি থেকে তরুণ সাংবাদিক মুস্তফা নুরুউল ইসলাম ও ফজলে লোহানী পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন খবর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় গুরুত্ব সহ প্রকাশিত হতো। এ কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি অবজারভার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। পেশাদার সম্পাদক আব্দুস সালাম ও মালিক প্রকাশক হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করা হয়।
বাংলা ভাষা আজ বিশে^র এক অনন্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন শুধু মাত্র শহীদ দিবস নয়, এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশে^ পালিত হচ্ছে। এজন্য আমাদের যে গর্ব, তার জন্য আমরা শ্রদ্ধায় অবনত হই ভাষা শহীদের প্রতি। সাথে এটাও মেনে নেই যে গনমাধ্যম জনমত গঠবে অনন্য। সংবাদকর্মীরা জনগনের কথা বলেন বলেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বারবার স্বৈরাচারের পতন হয়। ভাষা আন্দোলনের সংবাদপত্র গুলোও তেমানি ভাষাকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ভিত শিথিল করে দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফল তার প্রতক্ষ প্রমাণ।