বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক পাচার এবং মানব পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। একজন প্রকল্প পরিচালক দুর্নীতি করতে উন্নয়ন প্রকল্পের সব কার্যক্রম স্থবির করে রাখার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে। ফলে ওই প্রকল্পে সরকারকে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত গুনতে হবে। তাছাড়া আরেক কর্মকর্তা উচ্চ আদালতের আদেশও জালিয়াতি করেছে। শুধু তাই নয়, চাকরিতে থাকতে জালিয়াতির মাধ্যমে ২ বছর বেশি বয়স কমিয়েছে একজন কর্মচারী। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে বেবিচকের ওপর বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর এলাকার নিরাপত্তা থেকে শুরু করে সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ন্যস্ত। কিন্তু অপরাধী চক্রের সঙ্গে সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যুক্ত হওয়ায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। যদিও বেবিচক বলছে, তাদের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অপরাধে জড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে গত ডিসেম্বর মাসে ১০টি বিভাগীয় মামলা হয়েছে। পাশাপাশি ফৌজদারি মামলাও হয়েছে। ফৌজদারি মামলাগুলো বিচারাধীন। যাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান, তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে বেবিচক।
সূত্র জানায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায়ই চোরাচালানের স্বর্ণ ধরা পড়ছে। কোনোভাবেই চোরাচালান থামছে না। বিমানবন্দরে যে পরিমাণ চোরাচালানের স্বর্ণ ধরা পড়ে, তার কয়েক গুণ বেশি পাচার হয়। ওসব পাচারের সঙ্গে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু অনেক কর্মী জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মূলত আন্তঃদেশীয় অপরাধী চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচার করা হচ্ছে। বর্তমানে বেবিচকের ১০ জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা চলমান। কর্মচারীরা দায়িত্ব পালনের সময় স্বর্ণ পাচার করেছে। আবার কখনো তারা স্বর্ণ পাচারে সহায়তা করেছে। এমনও দেখা গেছে, দায়িত্ব পালন বাদ দিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে স্বর্ণ পাচার করতে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়েছে।
সূত্র আরো জানায়, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এটিএস শাখায় কর্মরত ট্রাফিক হ্যান্ড আকরাম হোসেন ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর কন্ট্রোল টাওয়ারে দায়িত্ব পালনকালে কাউকে না-জানিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে গিয়ে পতেঙ্গা থানা পুলিশের হাতে ১৬ পিস স্বর্ণের বারসহ গ্রেফতার হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রলিম্যান রেজাউল করিম-১, সশস্ত্র নিরাপত্তাপ্রহরী রেজাউল করিম, সশস্ত্র নিরাপত্তাপ্রহরি আবু তালেব, এরাড্রাম ফায়ার অপারেটর তাওহীদুল ইসলাম, সশস্ত্র নিরাপত্তাপ্রহরী মাহবুবুল আলম, মেকানিক জামাল উদ্দিন পাটোয়ারী, বোর্ডিং ব্রিজ অপারেটর হাফিজুর রহমান আকন্দ, হেলপার ইলিয়াছ উদ্দিন ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সাঁটমুদ্রাক্ষরিক মোমেন মুকাছেদ স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার বিভাগীয় মামলা চলমান। তাছাড়া শাহজালালের সশস্ত্র নিরাপত্তাপ্রহরী বেলায়েত হোসেন মোল্লাকে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর দায়িত্ব পালনের সময় বিমানবন্দর সিকিউরিটি অফিসার আটক করে। পরে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সামনে তার দেহ তল্লাশি করে ১৩ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। আর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বেলদার রাসেল খান মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে ভুক্তভোগীদের পাচারে জড়িত। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান এবং নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মানব পাচার আইনে মামলা রয়েছে। মানব পাচারের অভিযোগে ২০১৭ সালে র্যাব তাকে গ্রেফতার করে। আর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে শাহজালালের সশস্ত্র নিরাপত্তাপ্রহরী একেএম আমান উল্লাহ মিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। শাহজালালের এরাড্রাম ফায়ার রিডার এএসএম সেলিম ওরিয়েন্টাল ফাইন্যান্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ লি. নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। চাকরিতে নিয়োগ সংক্রান্ত অর্থ লেনদেনের অভিযোগে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক আবু হানিফার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। তাছাড়া হাইকোর্টের আদেশ জাল করায় সিএটিসি কুর্মিটোলার হিসাবনিরীক্ষক হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এফিডেভিটের মাধ্যমে জন্মতারিখ বদলে বয়স দুই বছর কমায় শাহজালালের নিরাপত্তা সুপারভাইজার আব্দুল বারেক শিকদার। আরো তিনজন কর্মীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা চলমান।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পরিচালক (প্রশাসন) মো. জহিরুল ইসলাম জানান, কোনো কর্মকর্তা যদি অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়ায় তাকে শোকজ করা হয়। যদি তার জবাব সন্তোষজনক না হয়, তবে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর ফৌজদারি মামলা হলে তাদের বিচার প্রচলতি আইনানুযায়ী হয়। চলমান বিভাগীয় মামলাগুলোর মধ্যে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি হওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়। সেখানে বেবিচকের কিছু করার নেই। সেক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলায় রায় হলে সেই অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি করা হয়।