বাংলা একটি ভাষার নাম। একটি চেতনার নাম। বাংলা সারা বিশ্বের অহংকার। কেননা পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালীরাই প্রথম ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। তবে ভাষাকে নিয়ে ভাবার ইতিহাসটা আরও আগের। ১৯৪০ সালে পাকিস্থানের লাহোরে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পৃথক রাষ্ট্রগঠনসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে একটি প্রস্তাব করা হয়। যা ইতিহাসে ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত। ১৯৪৭ সালে শুধুমাত্র ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্থান নামে দুইটি রাষ্ট্র। পাকিস্থানের আবার দুইটি ভাগ ছিল পূর্বে পূর্ব পাকিস্থান (বর্তমান বাংলাদেশ) আর পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্থান। পাকিস্থান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই দুই পাকিস্থানের মধ্যে শুরু হয় দুরত্ব। পশ্চিম পাকিস্থানে সকল উন্নতি সাধিত হয়। আর পূর্ব পাকিস্থান হতে থাকে অবহেলিত। পূর্ব পাকিস্থানে সকল দাবি-দাওয়া ভুলুন্ঠিত করতে প্রথমেই তারা আঘাত হাতে ভাষার উপর। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্থানের প্রথম গর্ভনর জেনারেল কায়েদে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেন। সেই সময়ে উপস্থিত ছাত্ররা না, না, বলে প্রতিবাদ করে। এভাবেই চলতে সাথে মনের সাথে মাতৃভাষার যুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালে। ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় আসেন। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্থানের ভাষা কি হবে সেটা পূর্ব বাংলার জনগনই নির্ধারণ করবে। কিন্তু উর্দুই হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ’। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই দিবসের কর্মসূচিকে সফল করতে ৪ ফেব্রুয়ারি ‘হরতাল এবং ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ ও বন্দী মুক্তি’ দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামীলীগ নেতা মহিউদ্দিন আহম্মদ অমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সকল ন্যায্য অধিকারের দাবিতে বাঙালীরা যখন ঐক্যবদ্ধ তখন ২০ ফেব্রয়ারি নুরুল আমিনের ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলায় ৮ই ফাল্গুন মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্র-জনতা মিছিল বের করে। সেদিন হাতে ছিল প্লাকার্ড । মুখে ছিল শ্লোগান। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলতে থাকে পরিষদ ভবনের দিকে। শান্তিপূর্ণ মিছিলটি মেডিক্যাল কলেজের সামনে এলে পুলিশ সেদিনের সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। রাজপথে শহীদ হন জব্বার, শফিউর, রফিক, বরকতসহ নাম না জানা আরও অনেকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেদিনের সেই ভাবনা, সেদিনের সেই চেতনা পরবর্তী সকল আন্দোলনে যুগিয়েছে প্রেরণা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ১৯৬৬ ছয়দফা, ১৯৬৯-গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় সবই ভাষা আন্দোলনের ফসল। সেদিন যে বাঙালী জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়েছিল তা বাঙালীর সকল আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। আন্দোলন ছাড়া যে বিজয় হয় না তা ভাষা আন্দোলন থেকে শিখতে পেরেছিল। পাকিস্থানীরা যে পূর্ব বাংলার উন্নতি বা সমৃদ্ধি চায় না তা বোঝা গিয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। তাই বলা হয় ভাষা আন্দোলনের মাঝে স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল। বাঙালীর অদম্য মনোবল দেখে, বাঙালীর ভাষার জন্য আন্দোলন দেখে ১৯৫৬ সালে পাকিস্থান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজ আমরা যে শহীদ মিনারে একত্রিত হয়, ফুল দেই সেটি উদ্বোধন হয়েছিল ভাষার মাস ২৪ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে। ভাবতেই কষ্ট হয় আজ আমরা যে মা, মা বলে প্রাণ জুড়াই, শিশুর মুখে হাসি ফোটে সে ভাষাকে পেতে কতই না কষ্ট করতে হয়েছে রফিক-জব্বারকে। তাঁরা না জাগলে আজ কোন ভাষায় মাকে ডাকতে হতো? আসলে কি এতো মিষ্টি হতো? আসলে কি মা উর্দুতে বলে শান্তি পেতাম? আমার মনে হয় না। ১৯৫২ সালের এই দিনে ভাষার জন্য রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। তবে একটি দুঃখের বিষয় দুঃখের ইতিহাসের সাথে বলতে হয় যে বাংলার জন্য জীবন দিল রফিক-শফিকসহ অনেকে অথচ আমরা কিন্তু সেই বাংলাকে কমই মনে রাখছি। আজ ১০০ জনকে বাংলা তারিখ ধরেন ৯৫ জন পারবে বলে মনে হয় না। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি বলছি সেটা কোন ভাষা? ধরে নিলাম আর্ন্তজাতিকতায় একুশে ফেব্রুয়ারি বলা হচ্ছে তবে জাতীয় দিবসগুলোতো আমাদের নিজস্ব। কেন সেগুলোকে ইংরেজিতে প্রচলন করা হলো? আমরা কি বাংলাতে জনপ্রিয় করতে পারতাম না? বাংলাতে করলে কি মুখস্থ হতো না? ভেবে দেখা দরকার। ভেবে দেখা দরকার এই বাংলাকে যারা বিকৃত করছে। কারণ বাংলাকে বিকৃত করলে কষ্ট হবে ভাষা শহীদদের। সেই সাথে বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার চাই। চাই বাংলার ব্যাপক প্রচলন। আজকে দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বেড়ে যাচ্ছে। তারা কি বাংলার ইতিহাস তারা কি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানবে? প্রশ্ন রাখতে চাই?? ভাষা আন্দোলন থেকে অধিকার আদায়ের শিক্ষা নেই। ভালবাসার শিক্ষা নেই। দেশপ্রেমের শিক্ষা নেই। একত্রে পথ চলার শিক্ষা নেই। মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট