উত্তর-আধুনিকতা কি ‘আধুনিকতার’ প্রতিক্রিয়া, না তার ফল? ঔপনিবেশিকতার যে উত্তর-প্রতিক্রিয়া থেকে উপমহাদেশ তথা বঙ্গে আধুনিকতার জন্ম ও বিকাশ, তা আদৌ অথবা কতটা মৃত্তিকা প্রোথিত অথবা বাইরে থেকে এনে রোপিত? বাংলা সাহিত্যে গত শতাব্দীর ত্রিশের কবিরা এর একটি দৃষ্টান্ত হতে পারেন। বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে ‘প্রতিভাবান বালক’-এর অতিরিক্ত কিছু বলে বিবেচনা করতে সম্মত হননি। এলিটিই এই ধারণা অথবা ভঙ্গি কি আধুনিক? বিষ্ণু দের বামপন্থা অথবা তার জনসম্পৃক্তিও অন্তত কাব্যশৈলীতে এলিয়টে স্বস্তি পেয়েছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভ্রান্তি তার আগের শতাব্দীতে মৃত্তিকাতে আশ্রয় পেয়ে সংশোধিত এবং উপযুক্ত আস্থায় বিকশিত হলেও পরবর্তী শতাব্দীতে এসে তা আবার বাধাগ্রস্ত হয়। আর সমকালে যিনি উত্তর-আধুনিকতা বিষয়ে বই লিখেছেন সেই মলয় রায় চৌধুরী তার পোস্টমডার্ন প্রবন্ধ : অ্যাটলাস ও পেরিক্লাস কবিতায় লিখছেন :
তবে ইংল্যান্ড ফ্রান্স আমেরিকায় ভাবুক বা সাহিত্যিকের বক্তব্য
আমি এড়িয়ে যাই
কেননা পশ্চিমবাংলার পোস্টমডার্ন অবস্থায় এগুলো খাপ খায় না
এটা ঠিক যে ওদের পোস্টমডার্নিজম অতি প্রযুক্তিবাদের ফল
আমাদের পোস্টমডার্নিজম আধুনিকতার পচনের ফসল
সেই সঙ্গে যুক্ত করা দরকার, সে আধুনিকতাও ধার করা, আমাদের বোধ ও বুদ্ধি থেকে জাত নয়। দুটি শব্দ থেকে বিষয়টিকে বোঝা যেতে পারে। ষাটের দশকে, বাংলাদেশের জন্মের পূূর্বে, এখন প্রবীণ কিন্তু তখন নবীন একজন কবি তার কাব্যগ্রন্থে ‘বীততিরিশ’ হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন তাদেরই সম্প্রসারণ। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমে গৌণ হয়ে যাওয়া সুররিয়ালিজমের ধারায় নিজেকে যে ‘পরাবাস্তববাদী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তা দৃশ্যত পরিশীলিত বলে মনে হলেও আসলে ছিল অনুকরণ। কিছুকাল আগে মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত শান্তি অন্বেষায় ‘রোডম্যাপ’ শব্দটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গে যে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাকেও নকল না বলে উপায় নেই। এর ফলে আমাদের সৃজনশীলতা কুম্ভীলকবৃত্তিতে আচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত হচ্ছে।
আমাদের শিল্পসাহিত্যে ‘আধুনিক’ প্রত্যয়টি ধার করা বলে এখানে তা ফলপ্রসূ ও সৃজনশীলতায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অথচ আমাদের তৃণমূলে সে সম্ভাবনা ছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বলেন, ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ এবং মুসলমানেরা, ‘মোল্ল¬ার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।’ আর লোকমানসের কথা, ‘নানান বরণ গাভীরে তার একই বরণ দুধ/জগত ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।’ এ থেকে আমাদের ইহলৌকিকতার যেমন তেমনি আন্তর্জাতিকতারও পরিচয় পাওয়া যায়। সৃজনশীলতাকে ভেঙে যেমন পুনর্নির্মাণ অথবা বিনির্মাণ করতে হয় কিংবা ডিসকোর্সের নানা পাঠ ও মাত্রা থাকে অথবা তা কেবলই একমাত্রিক ব্যাখ্যার দাসত্ব করে না এবং প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নানা মাত্রা আবিষ্কার করে তাতে আধুনিকতা থেকে উত্তর আধুনিকতায় রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি বোঝা যেতে পারে।
আমাদের বাস্তবতায় উত্তর-আধুনিকতাকে যদি প্রকৃত চারিত্র্যে শনাক্ত করতে হয় তাহলে তাকে উত্তর-উপনিবেশের অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেখতে ও বুঝতে হবে। এ ক্ষেত্রে এশীয়, আফ্রিকীয় ও লাতিন আমেরিকার বাস্তবতা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। নাইজেরিয়ার চিনুয়া আচিবি ও এনগুগি সিয়ালোর ইংরেজি ও মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা নিয়ে যে মতপার্থক্য আছে তা মূল দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ ততোটা নয়, যতোটা প্রক্রিয়াগত। আচিবির ইংরেজিও স্বাদে, বর্ণে, গন্ধে অনেকটাই আফ্রিকীয়। ফলে সিয়ালো যে কারণে নিজের মাতৃভাষা কিকুয়ীতে লিখতে চান, ইংরেজিতে লিখে আচিবিও তার কাছাকাছি পৌঁছুবার চেষ্টা করেন। ইংরেজিতে লিখে আচিবি বরং অনেক বেশি পাঠক ও ভিন্ন সংস্কৃতির কাছে পৌঁছুতে পারেন।
কিন্তু আচিবি তার লেখক সত্তার প্রকাশ ঘটান এই কথা বলে যে, যেখানে রাজশক্তির সঙ্গে লেখকের রয়েছে বিরোধ, সেখানে তিনি তার উদ্দেশ্যে মনভোলানো কথা বলতে পারেন না। লেখক যে তা বলেন না সেখানেই তিনি লেখক, বললে তিনি আর লেখক থাকেন না। এখানেই তিনি আধুনিকতাকে হজম করে উত্তর-আধুনিক হয়ে ওঠেন। তা যদি না হয় তাহলে তার আধুনিকতাই নকল, উত্তর-আধুনিক হয়ে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। উত্তর-আধুনিক বাস্তবতায় যিনি জনস্বার্থের অনুকূলে এবং সে কারণে রাজস্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে না পারেন তার পক্ষে লেখক অথবা সাংস্কৃতিক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের কয়েকটি ঘটনা থেকে বিষয়টিকে বোঝা যেতে পারে।
১. বিডিআর বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে সেনা আইনে অভিযুক্তদের বিচার করা যেতে পারে কি না সে বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো রেফারেন্স প্রসঙ্গে ২০০৯-এর ২৮ সেপ্টেম্বরের দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি কলামে মিজানুর রহমান খান দেখিয়েছেন আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২’র ৮ ধারার ১২ উপধারায় একে ঐবৎ গধলবংঃু'ং খধৎফ ঋড়ৎপবং হিসেবে উল্লে¬খ করা হয়েছে।
২. এই সেপ্টেম্বরেই ২০১০-এর একুশে পদকপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে একটি মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দৈনিক ও ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে।
৩. ২০০৯-এর ২ অক্টোবর জাতীয় সংসদের স্পিকারের নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৃত্তি প্রদান করতে গিয়ে তিনি বলেন, নিজে মেধাবী না হলেও অন্যায়, অসত্য ও দুর্নীতির সঙ্গে আপোশ করেননি বা লোভে পড়েননি। অন্যদিকে তার পর্যবেক্ষণ- ‘বর্তমানে মেধাবীদের অনেকে দুর্নীতি করছে এবং অসততার সঙ্গে আপোশ করে নীতিকে বিসর্জন দিচ্ছে।’
মুক্তিযুদ্ধ করে যে গণপ্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি, আটত্রিশ বছর পরেও যদি তার সেনাবাহিনী ঐবৎ গধলবংঃু'ং খধৎফ ঋড়ৎপবং থাকে, অন্তত লিখিতভাবে আমরা সেই সাক্ষ্য বহন করি কিংবা যে দেশের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত ও পালিত হয়, সেই দেশের মন্ত্রণালয় যদি সমস্ত রুচি ও কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে একুশের পদকপ্রাপ্তদের নিলামে তোলে, তাহলে কী বুঝব? আমরা আধুনিক, না উত্তর-আধুনিক পৃথিবীর বাসিন্দা? আর সেই ঘটনা ঘটেছে তখন, যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলে পরিচিত রাজনৈতিক দল ও জোটের ক্ষমতায় আসার নয় মাস পার হয়েছে বা হচ্ছে। এখন তার বয়স আড়াই। ক্ষমতাসীন প্রাক্তন দল বা জোটের দোহাই দিয়ে এক্ষেত্রেও কি দায় এড়াতে চাওয়া হবে? পতিত দল ও জোট যদি ক্ষমতার বাইরে থেকেও এতোটাই শক্তিশালী তাহলে জনগণের আর কার কাছেই বা কী প্রত্যাশা করার থাকে?
জাতীয় সংসদের স্পিকার যে বলেছেন তিনি বা তারা ‘ভালো’ ছাত্র না হয়েও নীতিকে বিসর্জন দেননি, আর এখন মেধাবীদের অনেকেই তা করছে তাতে কী বোঝা যায়? ‘মেধা’ও একটা পণ্য এবং স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার? এই বাস্তবতা কি ঔপনিবেশিক, আধুনিক, না উত্তর-আধুনিক?
এক্ষেত্রে একজন কবির সমকালীন সাক্ষ্য নেয়া যাক। ঢাকার দৈনিক ‘আমার দেশ’-এ তার নিয়মিত কলাম ‘সাহসের সমাচার’-এ আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘...বার্ধক্যে এসে মনে হচ্ছে আমি এক সকাতর তৃষ্ণার্ত কাকের গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে যাচ্ছি। কোকিলরা আমাকে দেখে মধুর শব্দে ডাকতে ডাকতে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। আর কাকেরা ভেবেছে, আমি তো কাক নই। এভাবে আমি এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে কোকিলও ডাকে না, কাকও রা কাড়ে না।’ তবে তিনি জানাচ্ছেন, তিনি ‘মধুরভাষী’ বলে লোকেরা এখনও তার কথা শোনে। ‘সোনালী কাবিন’-এর সনেটগুচ্ছের রচয়িতা তার নিজেরই জবানবন্দিতে না কোকিল, না কাকের আস্থা অর্জন করেছেন, তবে মানুষ তার কথা এখনও শোনে। সে কি সম্মোহন? শুধু কথা, কথা আর কথা? চারশো বছর আগে শেক্সপিয়রই তো এ বিষয়ে তার অনাস্থা প্রকাশ করে গেছেন। তাহলে উত্তর-আধুনিক এই সময়ে আমাদের প্ররোচিত করা কেন? যে কবি ১৪০০ বঙ্গাব্দে বলেন, ‘... কেবল সুন্দরের উপাসনায় কাটেনি আমার কাল/কুশ্রিতা, রক্তপাত, মহামারী, ক্ষুধা ও জাতিহত্যার পা-ুলিপি/আমি আজকের অস্তগমনের সাথে দরিয়ায় ডুবিয়ে/উপকূলের সবচেয়ে উঁচু পাথরে দণ্ডায়মান’ কিংবা জানান, ‘সকল পোশাক রেখে, এমনকি নুনে ভিজা নিমা/নিজের ছায়ার সাথে কথা বলি, ভালো নেই ভাই’ তার কাছে মধুর ভাষণের কেন এত মূল্য? তিনি কি আত্মপ্রতারণা করছেন? নাকি আমাদের বাস্তবতায় এভাবেই উত্তর-আধুনিকতার মুখোমুখি হচ্ছেন?
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় বৌদ্ধিক স্তরের যে একটি নির্মোহ মূল্যায়ন আহমদ ছফা ১৯৭২-এই করেছিলেন, তা স্মরণ রাখলে অবশ্য আমাদের খুব একটা বিস্মিত হতে হয় না। ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’ ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়, প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন, সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটেরদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা অন্ধভাবে হলেও ইসলাম, পাকিস্তান ইত্যাদিতে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চতুঃস্তম্ভে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা সারা জীবন কোনোকিছুতে যদি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেনÑ সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।’
দুই
রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রকে কার্যত উপেক্ষা করে সমাজকে মূল গুরুত্ব দিয়েছেন। তার জন্মের কালেই যেখানে কোম্পানি আমল শেষ হয়ে ইংরেজদের রাষ্ট্র তথা প্রশাসনিক কাঠামোয় ভারতবর্ষ প্রবেশ করেছে, সেখানে তার পরবর্তী সচেতন সময়ে রবীন্দ্রনাথের তার ও ভারতবর্ষে রাষ্ট্রকে উপেক্ষা করার এই প্রয়াস অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। তার উপন্যাস ‘যোগাযোগ’-এ মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া মধুসূদনকেও হয়তো তিনি এভাবে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন। কিন্তু পারেননি। তার পক্ষপাত, অন্তত সমর্থন বিপ্রদাস ও তার বোন কুমুদিনীর দিকে, কিন্তু মধুসূদন এতই প্রবল বাস্তব যে এদের স্রষ্টাও তাকে অস্বীকার করতে পারেননি। বিপ্রদাস ও কুমু সুরুচির অধিকারী হলেও তা যে সামন্ত মূল্যবোধ অর্জিত ও লালিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু শিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ জানেন, মধুসূদনকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। একইভাবে ব্রিটিশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেও অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করাও ছিল তার পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু তিনিই যখন প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’র সূত্রে একদিকে নিজের ‘জমিদারি’র পরিবর্তে ‘আসমানদারি’ করার কথা বলে আবার জানান, ভদ্রলোক ও ইংরেজের রাজগদি ভাগাভাগি করে নেয়ার নাম রাজনীতি, যা আজও পর্যন্ত উপমহাদেশের সঙ্গে বিশেষভাবে বাংলাদেশেও অত্যন্ত বাস্তব ও কার্যকর তখন বোঝা যায়, কবি হলেও কিংবা কবি বলেই আমাদের উত্তর-আধুনিকতার প্রায় সব ফাঁক ও ফোকরকে আসল জায়গায় গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশ-উত্তরকালে নানা সময়ে তথাকথিত গণতান্ত্রিক অথবা সামরিক বা বেসামরিক স্বৈরাচারের কালে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন ও তাতে হিস্যা লাভের যে কাণ্ড-কারখানা ঘটেছে বা ঘটে চলেছে তাতেও বোঝা যাবে, উত্তর-আধুনিকতা নেহাতই বহিরঙ্গের ঘটনা মাত্র, প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার ভয়ঙ্কর মুখোশ ছাড়া আর কিছু নয়। আশির দশকের শুরুতে পুনরায় সামরিক স্বৈরাচারের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে তার এক চূড়ান্ত ও কুৎসিত প্রকাশ ঘটে। একজন কবি, যার কথা আমরা আগেই উল্লে¬খ করেছি এবং যিনি ব্যক্তিগতভাবে তার দ্বারা উপকৃত হয়েছেন সেই শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পরের বছর ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ নামক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতদিন ‘বামপন্থা’র কথা বললেও এর মধ্য দিয়ে তিনি ডানপন্থার ‘অধ্যাত্ম’য় প্রবেশ করেন। তারপর তিনি এক বিশেষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিনি শুধু সমুদ্রভ্রমণেই যাননি, তা নিয়ে কবিতাও লেখেন। ফলে এর পরবর্তী স্বৈরশাসকের সঙ্গেও সখ্য গড়ে উঠতে তার সময় লাগেনি। বিষয়টি যে শুধু কাব্যের মধ্যেই সীমিত থাকেনি, বরং তাতে বস্তুস্বার্থও যুক্ত হয়েছিল, বাংলাদেশের ‘উত্তর-আধুনিক’ এই সময়ে যারা বসবাস করেন তাদের জন্য তা বিস্মিত হওয়ার মতো কোনো সংবাদ ছিল না।
তবে বামপন্থায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যিনি একসময় সে ধারার কবিতা লিখেছেন তিনি যখন ইউটার্ন করে বলেন, একটি কথিত ঐ ধারার দৈনিকের সম্পাদক হওয়াটা ছিল তার বেতনপ্রাপ্তির পেশাদারী দায়িত্ব মাত্র এবং নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তার সম্পূর্ণ বিরোধী ঘৃণ্য রাজনৈতিক দল ও অপশক্তির পক্ষে কাজ করেন এবং বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘সমাজতন্ত্র কুফরি মতবাদ’ তখন সেই অধঃপতন মানুষকে বিস্মিত ও দুঃখিত করেছে। তবে পচনশীল অঙ্গকে পরিত্যাগ করার মতো মানুষ তাকে বিস্মৃত হতে চেয়েছে। কিন্তু আবার একই সঙ্গে আমাদের জাতিসত্তার বিকাশে তার রচনার অবদানকে তারা ভুলতে চায়নি অথবা পারেনি। দ্বান্দ্বিক এই বাস্তবতাকে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আধুনিক’ থেকে ‘উত্তর-আধুনিক’ দ্বিধা অথবা সংশয় হিসেবে দেখা যেতে পারে। অথবা একে লাভ-হেট রিলেশানও বলা যায়।
অন্যদিকে যে স্বৈরশাসন বা শাসকের কথা বলেছিলাম তার রাজনীতি লুম্পেনের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছিল। অন্যায় ও নিন্দনীয় হলেও তাতে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। কারণ স্বৈরশাসক তো স্বৈরশাসকই হবে। কিন্তু আমরা যখন দেখি তথাকথিত প্রগতিশীলদের কেউ কেউ তাকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন তখন আমাদের মতো দেশের উত্তর-আধুনিকতার নকল প্রকাশ লক্ষ করি। হাসান হাফিজুর রহমানের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে সেই উপলক্ষে স্বৈরশাসকের পেছন পেছন একজন লেখকের ঘোরাফেরা আমাদের স্মৃতি থেকে এখনও মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। এ উপলক্ষে স্বৈরাচারীর পৃষ্ঠপোষকতায়, মূলত তারই নেপথ্য প্ররোচনায় যে ‘এশীয় কবিতা উৎসব’-এর আয়োজন করা হচ্ছিল তাতে যোগদানের জন্য তিনি প্রায় তৈরি হয়ে ছিলেন। কিন্তু নানা বাস্তব বিবেচনা করে অবশেষে জাতীয় কবিতা পরিষদে এসে যোগ দেন।
বিষয়টি শুধু বাংলাদেশেই সীমিত থাকেনি। যে সামরিক শাসক ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বা ওই সড়কে আল্পনা আঁকাকে হিন্দুয়ানী ও পৌত্তলিক প্রথার অনুসরণ বলে ঘোষণা করেন এবং এ জাতীয় প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে চান; কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকা রাইফেলের মাথায় ফুল এঁকে ও সম্পাদকীয় লিখে তাকে স্বাগত জানায়। এমনকি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয় তখনও আনন্দবাজার গোষ্ঠীর একদল লেখক-সাংবাদিক আগ বাড়িয়ে ঐ স্বৈরাচারীর পক্ষে বিবৃতি প্রকাশ করেন। ঠাকুর ঘরে কে, কলা খাই না, জাতীয় এসব আচরণ মোটেই কাকতালীয় নয়, ‘উত্তর-আধুনিক’ বাস্তবতার অতি ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিক্রিয়া। লক্ষণীয়, ‘এশীয় কবিতা উৎসব’-এ যোগ দেওয়ার জন্য তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। কবি ও কবিতার এভাবে ‘সংবাদ’ হয়ে ওঠাটাও ছিল ঐ সময়ের স্বনির্ধারণী ব্যাখ্যা কিংবা অন্তত তার টীকা।
সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টিকে অন্যভাবে বোঝা যেতে পারে। চূড়ান্ত দারিদ্র্যের সময়ও বেশি অর্থ পাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যিনি তার লেখা উপন্যাস বা এ জাতীয় রচনা প্রকাশে ছিলেন অনীহ; যিনি কবিতাকে শুদ্ধ শিল্প বিবেচনা করতেন এবং যার সম্পর্কে ধারণা ছিল কবিতা ছাড়া তিনি আর কিছু লেখেন না, এমনকি ভাবেন না পর্যন্ত, তার সম্পর্কে জানা গেছে, তার কথাসাহিত্য ও গদ্য রচনার সংখ্যা কী বিপুল! ওই সব লেখার মধ্য দিয়ে তার আসলে ভেন্টিলেশন ঘটেছিল।
বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে এর সুযোগ না থাকায় কিংবা শিল্পী-লেখকরা সেই সুযোগ গ্রহণ না করায় তা এক ধরনের দূষণের সৃষ্টি করছিল, যার বিষনিঃশ্বাস অথবা কুবাতাস থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি।
তিন
ইংরেজি অনুবাদে মিশেল ফুকোর বইয়ের নাম : গধফহবংং অহফ ঈরারষরুধঃরড়হ : অ ঐরংঃড়ৎু ঙভ ওহংধহরঃু ওহ ঞযব অমব ঙভ জবধংড়হ. হ্যামলেট প্রসঙ্গে পোলেভনিয়াসের উক্তির কথা মনে হতে পারে : ওঃ ঞযরং ইব সধফহবংং ঃযবৎব রং সধঃযযড়ফ রহ'ঃ. ফুকো ফ্রান্সের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলেজ দ্য ফ্রান্সের ‘চিন্তা পদ্ধতির ইতিহাস’-এর অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে পরীক্ষা দেওয়া বা নেওয়ার এবং অভিধা পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। আর আমাদের এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে রক্ষণশীলতার দুর্গ। অবশ্য এসব জায়গায় যে ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে বা ঘটে চলেছে তাতে প্রকৃত মুক্তিও এক অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এই বিষচক্র থেকে না বেরুনো পর্যন্ত আমাদের উল্টোযাত্রা চলতেই থাকবে।
নজরুল ও জীবনানন্দের কাব্যশৈলীতে অনেক পার্থক্য। তবে বয়সে অগ্রজ হয়েও জীবনানন্দ নজরুলকে তার আবির্ভাব ও বিকাশের কথা বিবেচনা করে জ্যেষ্ঠের মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু তারা উভয়ে সময়ের বিশাল ব্যাপ্তির কথা জানতেন। বাস্তব রাজনীতির প্রসঙ্গে বললেও নজরুলের মন্তব্য শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ‘পলিটিক্যাল তুবড়িবাজি’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘সে কঠিন সাধনার তারিখ নাই; ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯২৩ বা ফেব্রুয়ারির শেষ, ১৯২৬ এর ভিতর তাকে সীমাবদ্ধ করলে চলবে না।’ আবার জীবনানন্দ সময়কে মেপেছেন শতাব্দী অথবা হাজার বছরের হিসেবে। ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতায় তাই তিনি ‘ঊনিশ শ অনন্তের জয়’ ঘোষণা করেন। উত্তর-আধুনিকতা সময়কে সীমিত অথবা গ-ীবদ্ধ করে না। বরং তা তার নতুন মাত্রাকে আবিষ্কার করে। ১৯২৩ বা ২৬-কে যেমন তা ছাড়িয়ে যায় তেমনি তা অনন্তেও সম্প্রসারিত হয়। নবায়িত ও উত্তরিত হওয়া ছাড়া সময়, বস্তু অথবা চিন্তার বিনির্মাণ ঘটে না। আর উপনিবেশের মধ্যে জন্ম নেওয়া বাস্তবতার তো সদাসতর্ক না হলেই চলে না।
খুব সাম্প্রতিক উদাহরণ থেকে ব্যাপারটাকে বুঝে নেওয়া যাক। আলফ্রেড খোকন যখন তার কবিতার নাম রাখেন ‘ঔপনিবেশিক মজমায়’ এবং সেখানে লেখেন ‘কথারা আসছে’ কিন্তু সতর্ক করে দেন ‘সাবধান! মুখ খুললে সবাই পাথর হয়ে যাবেন’, তখন ‘আধুনিক’ ও ‘উত্তর-আধুনিক’ দ্বন্দ্বে পড়লেও ভাবি, এ থেকে আমাদের বেরুতেই হবে। আহমেদ নকীবের ছোট দুটি কবিতার দুটি সামান্য অংশ পড়া যাক :
১. সংশয় থেকে একটা কলম তৈরি হয়; আমি
কলমটাকে আলগোছে ধরি যেন সে ভেঙে না যায়;
জোরে চেপে ধরলে কলমের ট্রান্সপারেন্ট বডির
ভেতর কালির দলা হাঁসফাঁস করে ওঠে;
[সংশয়ের কলম]
২. আয়না বলছে, হাসতে হবে
কী আর করা, কৌণিকভাবে
বার্তা পাঠাই ঠোঁটে আর তাই
হয়ে ওঠে প্রতিউত্তর;
আয়না বলছে, হলো না তো [মন]
কিন্তু হতেই হবে। সেখানেই বঙ্গীয় বাস্তবতায় উত্তর-আধুনিকতার পরীক্ষা অথবা নিরীক্ষা।