সঞ্চয়ের অভ্যাস আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুব ছোট থেকেই এই সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে আজকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় আগামী দিনে সাহায্য করবে। এক সময় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মাটির তৈরি ব্যাংক ছিল। প্রতিদিন খুব সামান্য হলেও কিছু অর্থ সেই মাটির ব্যাংকে জমা রাখতো পরিবারের মানুষ। এর মধ্যে পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও ছিল। আজ সেই মাটির ব্যাংক খুব বেশি দেখা যায় না। তবে ছাত্রছাত্রীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চালু হয়েছে স্কুল ব্যাংকিং। সঞ্চয়ের চর্চা ছাত্রজীবন থেকে শুরু হওয়ার কারণে ভবিষ্যতেও সে এই ধারা অব্যাহত রাখে। এই সঞ্চয় থেকে প্রয়োজনের সময় বড় ধরনের সাহায্য পায়। ছাত্রজীবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ সময় চরিত্র, ব্যক্তিত্ত এবং মানসিকতা গড়ে তোলার সময়। এসময় থেকেই সঞ্চয় মনোভাব গড়ে তোলার লক্ষেই স্কুল ব্যাকিং ধারণাটি এসেছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা অতি ক্ষুদ্র অংশও জমা রাখতে পারে। এট একটা মনোভাব যা তার ভবিষ্যতের মিতব্যয়িতা এবং সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠা সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি বড় হলে তাকে মিতব্যায়ী হতে সাহায্য করে। সে অপচয় করতে ঘৃণা করে এবং সর্বদা পরিমিত ব্যায় করতে শেখে। বাংলাদেশে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম বেশ সফলভাবেই এগিয়ে চলেছে । প্রতিদিনই স্কুল ব্যাংকিং এর অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ও সঞ্চয় স্থিতির পরিমাণ বাড়ছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, স্কুল শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং সুবিধা ও তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবার সঙ্গে পরিচিত করানোর লক্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের ২ নভেম্বর স্কুল ব্যাংকিং বিষয়ে একটি পরিপত্র জারি করে। এরপর থেকেই স্কুল পড়–য়া কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় মুনাফার নানা স্কীম চালু করে। ২০১০ সালে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হলেও শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। প্রথম বছরে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা হয় ২৯ হাজার ৮০ টি। স্কুল ব্যাংকিং শুরু হওয়ার ১০ বছরের ব্যবধানে অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ২৬ লাখ দাড়িয়েছে। একই সময়ে সঞ্চয় স্থিতি বেড়ে দাড়িয়েছে ১ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ২৬ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ টি হিসাবের বিপরীতে জমাকৃত সঞ্চয়ের পরিমাণ দাড়িয়েছে ১ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যাবধানে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৯৬৬ টি। অর্থাৎ এক বছরে হিসাব সংখ্যার প্রবৃদ্ধি ৩৬ শতাংশ। এই সময়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের জমানো আমানত বেড়েছে ৩০৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ক্রমেই আমাদের দেশে স্কুল ব্যাংকিংয়ে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ বাড়ছে। এর অর্থ যে, ছাত্রছাত্রীদের জীবনের শুরু থেকেই সঞ্চয় এবং মিতব্যায়ীতার মনোভাব গড়ে উঠছে। কেন্দ্রিয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী স্কুল ব্যাংকিংয়ের মোট হিসাবের ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ খোলা হয়েছে গ্রামাঞ্চলে এবং ৬৩ দশমিক ৮২ শতাংশ খোলা হয়েছে শহরাঞ্চলে। স্কুল ব্যাংকিং সেবাকে জনপ্রিয় করতে ব্যাংকগুলো নানা উদ্যোগ নিয়েছে। স্কুল ব্যাংকিং হলো সঞ্চয়ের শুরু। এখান থেকেই একজন শিখতে পারে সঞ্চয়ের গুরুত্ব। ফলে এই কার্যক্রমকে আরও জোরদার করতে হবে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এই কার্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ব্যাংকিংএ উৎসাহিত করতে হবে। এই সঞ্চয় নিজের সাথে সাথে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখবে।
সঞ্চয়ের সাথে সাথে মিতব্যয়ীতা ধারনাটিও অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। মিতব্যায়ীতা হলো পরিমিত ব্যয়ের অভ্যাস। একদিকে ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখা অন্যদিকে মিতব্যয়ী হওয়া- এই দুইয়ে মিলে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়ে ওঠে। ব্যয় শব্দটি আয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। যার যতটুকু আয় তার সেভাবেই ব্যয় করা উচিত। অর্থাৎ আয় বুঝে ব্যায় কর। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকেরই তার আয় বুঝেই ব্যয় করার অভ্যাস করা উচিত। এছাড়া সংসারে সঞ্চয় সম্ভব হয় না। অতিরিক্ত ব্যয় কোন সংসারের জন্যই মঙ্গলজনক নয়। এটা আমাদের ধর্ম ও গুরুজনরা সবাই বলে থাকে। যেটুকু ব্যয় করলে সংসার পরিচালনা করা সম্ভব সেটুকু ব্যয় করে বাকিটুকু সঞ্চয় করাই মিতব্যয়ীতা। অনেক সময় মিতব্যয়ীতাকে কৃপণতার সাথে তুলনা করা হয়। অবশ্য সমাজের সেই সব লোক এটা বলে যারা নিজেদের অপরিমিত ব্যয়কারির কাতারে দাড় করায়। কিন্তু এ ধারণা ভুল। কৃপণতার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কৃপণতা হলো প্রয়োজনের সময়ও খরচ না করা আর মিতব্যয়ীতা হলো প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় অংশটুকই শুধু খরচ করা। সঞ্চয় মানে হলো ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখা। এই ভবিষ্যতের সঞ্চয় নিয়ে আমাদের দেশে রয়েছে নানা প্রবাদ-প্রবচন। ছোটবেলায় সারাংশতে পরেছি ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ। সঞ্চয় ভবিষ্যতের ভাবনাকেই আলোড়িত করে। এই সঞ্চয় আমাদের ভবিষ্যতের চাহিদা মেটায়। ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ি তোলে মহাদেশ সাগর অতল- কবিতার এই লাইনের মধ্যেই সঞ্চয়ের মূল ভাব নিহিত রয়েছে। জলের প্রতিটি কণা যেমন সাগর তৈরি করে,তেমনি সাগরের জল একেকটি জলকণার সমন্বয়ে গঠিত। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকেই বৃহৎ কিছু গড়ে তোলা সম্ভব এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত করে।
স্কুল ব্যাংকিং আজ দেশের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ভেতর সঞ্চয়ে স্পৃহা তৈরি করেছে। এই স্পৃহা একদিকে যেমন তাদের সঞ্চয় করতে উদ্বুত্ত করছে তেমনি অতিরিক্ত অর্থ কোনো অসৎ কাজে ব্যয় করা থেকে বিরত করছে। এছাড়াও স্কুল ব্যাংকিং ছাত্রছাত্রীদের ভেতর সৎ চেতনা জাগ্রত করছে। এতে তারা মোবাইল ও ক্ষতিকর ডিভাইস থেকেও দূরে থাকছে। একটি সুন্দর, নিরাপদ এবং মজবুত ভিত গঠনে স্কুল ব্যাংকিং একটি কার্যকরী উদ্যোগ।
অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলাম লেখক