করোনার প্রভাবে দেশের শিল্প উৎপাদনে গতি এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। ফলে বেসরকারি খাতে এখনো ঋণের চাহিদা বাড়ছে না। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ কমে গেছে। আর ঋণের চাহিদা কম হওয়ার গ্রামীণ অর্থনীতি ও উন্নয়ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য কৃষি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বাজারে অর্থ সরবরাহ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তুরাজস্ব আহরণে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে। কারণ এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ের হার কমেছে। তবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতিতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। সেজন্য অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ইতিবাচক ধারা বইছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে শিল্প খাতে ১৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয়। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। পাশাপাশি ওই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। আদায় পরিস্থিতি গত অর্থবছরের ওই সময়ের তুলনায় ৪৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। সার্বিকভাবে ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কম ছিল। বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবাহ কম হওয়ার অর্থ ওই সময়ে বিনিয়োগ কমেছে। পাশাপাশি শিল্প-কারখানাও পুরোদমে চালু হয়নি। তবে মধ্যম ও বড় পর্যায়ের শিল্প প্রতিষ্ঠানে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে উৎপাদনের সূচক ৪৪০ দশমিক ২১ পয়েন্টে উঠেছে। ২০১৯ সালের এই সময়ে ওই খাতে উৎপাদনের সূচক ছিল ৪১১ দশমিক ৬০ পয়েন্ট। অবশ্য উদ্যোক্তাদের মতে, সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের পর ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিকতা ফিরে পাচ্ছে। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানও কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু ওসব প্রতিষ্ঠান এখনো পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতায় কাজ করছে না। তাছাড়া আরো অনেক খাত এখনো পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা ফিরে পায়নি।
সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমেছে। শুধু ডিসেম্বর টু ডিসেম্বর মাসভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হারও কমেছে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে আমদানি কমেছে ২১১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় আমদানি কমেছে ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। তবে ওই সময়ে বাজারে মুদ্রা সরবারহ বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাবে গত বছরে ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে। অবশ্য কোভিড-১৯-এর ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন কাজ করছে। কারণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার মোট ২৩টি প্যাকেজে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা ব্যয় করছে। তারপরও ঘুরে দাঁড়ানোর পথে থাকলেও অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। তার মধ্যে হচ্ছে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ধীরগতি। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে মোট ১ লাখ ১০ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা বেশি, অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে ওই সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ২২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে ৩০ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় পিছিয়ে আছে।
সূত্র আরো জানায়, গত অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয়নি। তখন স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। অথচ চলতি অর্থবছর মহামারি নিয়ে শুরু হয়েছে। তারপরও প্রথম ৬ মাসের রাজস্ব আদায়ে গত অর্থবছরের তুলনায় ৪ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হচ্ছে। আর অর্থনীতিতে সুবাতাস হচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৩৪৫ কোটি মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। একই সময়ে বৈদেশিক সহায়তা এসেছে ২০৪ কোটি ডলার। তাও গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বিআইডিএসের সাবেক ডিজি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি জানান, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। করোনার সময় সার্বিক অর্থনীতিতে স্থবিরতা ছিল। তবে এখন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে পারলে কর্মকা-ে আরো গতি বাড়বে। কৃষি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়লেও অকৃষি খাত অর্থাৎ বেসরকারি খাতে বাড়ছে না। সেজন্য এসএমই খাতে বিশেষ নজর দেয়া জরুরি। কারণ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়লে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার পাশাপাশি দ্রুত উন্নয়নের গতি বাড়বে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও আয় বাড়বে।