অত্যান্ত জাকজমকপূর্ন ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ দিন ব্যাপী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বছর ব্যাপী পালন শুরু হলো। ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ‘মুজিব চিরন্তন’ শিরোনামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানের স্বশরীরে এবং বিশে^র প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার প্রধানেরা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বলেছেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। বিশে^ উন্নয়নের মডেল হিসেবে স্বীকৃত এখন বাংলাদেশ।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আজ অর্ধশতাব্দি। অনেক অর্জন থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী মানবতা বিরোধী অপরাধী ঘাতক রাজাকার আলবদর, আলসামস বা পিচ কমিটির সদস্যদের নামের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে আমরা সক্ষম হইনি। দায়সারা গোছের একটি তালিকা প্রকাশ করলেও তা এতটাই বিতর্কিত যে শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়েছে এবং বিচারের রায় কার্যকর করাও হয়েছে।
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের যাত্রা শরু হয়। এর প্রায় দু’বছরের মাথায় ২০১২ সালের ১২ মার্চ আরেকটি ট্রাইবুনাল ট্রাইবুনাল-২ গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইবুনালকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইবুনাল করা হয়। গত ১১ বছরে মোট ৪২টি মামলার রায় হয়েছে। তাতে দন্ডিত আসামির সংখ্যা শতাধিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে এখন ৩০টি মামলা বিচার পর্যায়ে রয়েছে। এর বাইরে মানবতা বিরোধী অপরাধের আরো ২৬টি অভিযোগের তদন্ত চলছে।
ট্রাইবুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ছয় আসামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। তারা হলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ও মীর কাশেস আলী এবং বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী। আর আমৃত্যু কারাদন্ড ভোগ করছেন জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাইদী। এর বাইরে ৯০ বছরের কারাদন্ডাদেশ প্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও আমৃত্যু কারাদন্ডপ্রাপ্ত সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম কারাগারে থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত জামায়াতের আরেক নেতা আবদুস সোবহান ও মারা যান কারাগারে। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটি এম আজাহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের রায় পুন:বিবেচনা আবেদন এখন আপিল বিভাগে শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে। মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামীদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াত নেতা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, মো: আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈন উদ্দিন বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত। পলাতক আসামীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জাহিদ হোসেন, সৈয়দ হাসান আলী, এটিএম নাসির, আবু সালেহ মুহম্মদ আবদুল অজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ এ রুহুল আমিন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারে ৪২টি মামলার ১১৬ আসামীর মধ্যে ১২ জন মারা যান রায় ঘোষনার আগে। একটি মামলায় এক আসামী খালাস পেয়েছে। ৪২টি মামলায় ট্রাইবুনাল ১০৩ জনকে দন্ড দেন। এদের মধ্যে ৭১ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়। আমৃত্যু কারাদন্ড হয় ২২ জনের। অপর আসামীদের বিভিন্ন মেয়াদে দন্ড দেয়া হয়।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আক্ষ্যায়িত করে আদালতের একটি রায়ে বলা হয়েছে, দেশের কোন সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতা বিরোধীদের থাকা উচিত নয়। আদালত একটি রায়ের সাথে দেওয়া পর্যবেক্ষনে বলেছে, একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে সরকার চাইলে দল হিসেবে জামায়াতের’ও বিচারের উদ্যোগ নিতে পারে। আদালতের সেই পর্যবেক্ষন অনুযায়ী ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইনি কাঠামো তৈরীর কাজ শুরু করলেও সেটির উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এছাড়া জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে ২৫ জন বিশিষ্ট আলেমের করা একটি মামলা এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধিন।
স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে নির্ষিদ্ধ করার দাবী জানিয়ে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে একাত্তরের ঘাতক দালাল কামিটি সহ নানা সংগঠন। শাহবাগ ভিত্তিক গণজাগরণ মঞ্চও এ দাবির সমর্থনে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টিও জামায়াত মুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত পাক হানাদার বাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেছে। তারা হানাদার বাহিনীকে এদেশের পথঘাট চিনিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জ¦ালিয়ে লুটপাট করেছে; এদেশের মা বোনদে তারা হানাদার বাহিনীকে এনাম দিয়েছে।
রাজাকার আলবদর, আলসামস বা পিস কমিটির সদস্য হয়ে বাঙ্গালির জীবনকে অতিষ্ট করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর তারা এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা দু:খ প্রকাশ করে না করেই রাজনীতির মাঠে ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালে দলের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক দল থেকে পদত্যাগ করেন ক্ষমা বা দু:খ প্রকাশের দাবিতে। যদিও ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের প্রধান আইনজীবী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আইনজীবীরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামের বিচার করতে হলে, আইন সংশোধন করতে হবে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করা হয়নি এখন পর্যন্ত। আইন সংশোধনের একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তার কোন অগ্রগতি নেই। আবার কোন মামলাও হয় নি। তবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোটের রায়ের বিরুদ্ধে একটি আপিল এখনো বিচারাধীন।
২০১৮ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। ফলে দলীয় ব্যানারে কোনো নির্বাচন অংশ নিতে পারছে না দলটি। তবে দলটি তার দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৩ সালের ১ আগষ্ট রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষনা করে। রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল ও আপিল করে দলটি। গত ৮ বছরের আপিলটি শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে। প্রসঙ্গত: জামায়াতের রাজনীতির সুচনা হয়েছে উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আল মওদদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর ১৯৬৪ সালে মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধাচারন করায় তখন জামায়াতকে নির্ষিদ্ধ করা হলেও পরে সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জামায়াত বিরোধীতা তো করেছেই আর ১৯৭১-এর রক্তঝরা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে এদেশের মানুসের ওপর জুলুম নির্যাতন চালায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো নিষিদ্ধ হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর আবারো জামায়াত সক্রিয় হয়ে ওঠে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে একটি মামলা রয়েছেন সেই মামলার রায় যতক্ষন পর্যন্ত হবে না, ততক্ষন আমরা কোনো কিছু করতে পারবো না।’ জামায়াতের বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ, গনহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ সহ সাত ধরনের অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে রাষ্ট্র পক্ষের প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন দেয়। এরপর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও জামায়াতের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয় নি। আইন মন্ত্রী আনিসুল হক সাংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাদীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার রায়ে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে দল হিসাবে যুদ্ধাপরাধে জড়িত বলে উল্লেখ করেছে। দল হিসেবে জামায়াতের বিচার প্রক্রিয়ার জন্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনের সংশোধনী তৈরী করেছে। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হবে।’ কিন্তু সে সংশোধনী কোথায়? দু’টি পার্লামেন্ট তার মেয়াদ পূর্ন করেছে। নতুন পার্লামেন্টেরও কটি অধিবেশন হয়ে গেল। অথচ আইনটি পার্লামেন্ট ওঠা তো দুরের কথা মন্ত্রী পরিষদ বৈঠকেও অনুমোদন করা হয়নি। তাই দল হিসেবে জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া কবে কখন শুরু হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। তবে দলের নিবন্ধন বাতিল হলেও তারা তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে অনলাইনে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে তারা বছর ব্যাপী কর্মসূচিও পালন করছে বলে অনলাইনে পোষ্ট দিয়েছেন দলের মহাসচিব।