আজকাল মশা যেভাবে কামড়াচ্ছে তাতে করে নির্বাচনের সময় কামড়ের জ¦ালা বোধ করি সিটি মেয়ররা টের পাবেন। মশা অতি ক্ষুদ্র এক কীট হলেও ক্ষমতার গদি নড়বড়ে করতে এর জুড়ি নেই। মশানিধনে ব্যর্থ হয়ে অনেকে পড়েছেন বিপাকে। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তারপরও ঢাকার রাজনীতিতে মশা বরাবরই একটি বড় ইস্যু।
চলতি বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে দুবাই ছিলাম ১১ দিন। একটি মশাও দেখিনি দুবাইজুড়ে। উড়োজাহাজ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লেন্ডিংয়ের পর দরজা ওপেনের সঙ্গে সঙ্গে 'বাংলাদেশ মশা বাহিনী' যেন হুমড়িখেয়ে বিমানের বুকে পড়ল। তারপর শুরু হলো বাংলামশার জুলুম। যেদিন যাচ্ছি সেদিন বিমানে যে পরিমাণ মশার কামড় খেয়েছি আর বিমান উড্ডয়নের পর দেশের সীমানা পেরুলেও বাংলামশার জুলুম অত্যাচার কমেনি। বোধ করি, বাংলাদেশ মশা বাহিনীর সদস্যরা দুবাইতেও আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল। যে পরিমাণ কামড় দিয়েছে আমার দেশি মশা- ১১ দিনেও দাগ আর ফুলা কমেনি। দেশে ফিরে আসার পর মশাদের যে জুলুম হচ্ছে তার বর্ণনায় নাই বা গেলাম। গোটা দুবাই লেক আর নদী ঘেরা। প্রায় সবটাই কৃত্রিম। আর আমরা আলস্নার দেওয়া লেক, নদী ভরাট করছি নিত্য। ঢাকায়তো এখন আর খালের অস্তিত্বই নেই বলা চলে। জলাধার ভরাটে নিঃস্ব প্রায়। জানি যত জল তত মশা। দুবাইয়ে জলাধার বেশি মশা নেই আর আমাদের জলাধার কম মশা বেশি। আসলে আমাদের দেশে অনেক কিছুই উল্টো হয়। সোজা কারবার কম। সোজা কথা মশার জ¦ালায় দেশবাসী অতিষ্ঠ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গত বছরের এ সময়ের তুলনায় বর্তমানে মশার ঘনত্ব বেড়েছে চার গুণ। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ কম। চলতি অভিযানে মশা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া কঠিন কাজ। ধারণা করা হচ্ছে, মশা না কমে যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী এপ্রিলে মশার ঘনত্ব বেড়ে চরমে পৌঁছাবে। যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে কীট বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। মশা নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, মশার ঘনত্ব অন্য সময়ে যা থাকে তার চেয়ে চারগুণ বেশি বেড়েছে এখন। গত বছরের এপ্রিল থেকে শুরু করা হলে জানুয়ারিতে অন্যান্য মাসের তুলনায় চারগুণ মশার ঘনত্ব পেয়েছি, বিশেষ করে লার্ভার ডেনসিটি। 'সত্যিই রাজধানীতে মশারা বশে আসছে না। শীত শেষে রাজধানী ঢাকায় দাবড়ে বেড়াচ্ছে মশারদল। মশককুল রাজধানীতে রামরাজত্ব কায়েম করেছে। এ মশা দুই সিটি করপোরেশনের সুনামে হুল ফুটাচ্ছে! ফুটাবেও। যখন লিখছি তখন মশার দল হুল ফুটাচ্ছে পায়ে, মুখে, গালে। মশার এ যাতনা উভয় সিটি করপোরেশনের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এ বছর রাজধানীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় মশার উৎপাত একটু বেশিই। মশার দাপট আরও নাকি বাড়বে। এলাকার বাসিন্দারা এজন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (উত্তর, দক্ষিণ) অবহেলাকে দায়ী করেন। দোহাই নয়া মেয়রদ্বয় আপনারা মশা ঠেকান! এখানে ব্যর্থ হলে জনগণ তার জবাব দেয়ই দেয়। বিগত ইতিহাস থেকে তাই শিখেছি আমরা। আজকাল মশা যেভাবে কামড়াচ্ছে তাতে করে নির্বাচনের সময় কামড়ের জ¦ালা বোধ করি সিটি মেয়ররা টের পাবেন। মশা অতি ক্ষুদ্র এক কীট হলেও ক্ষমতার গদি নড়বড়ে করতে এর জুড়ি নেই। মশানিধনে ব্যর্থ হয়ে অনেকে পড়েছেন বিপাকে। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তারপরও ঢাকার রাজনীতিতে মশা বরাবরই একটি বড় ইস্যু। প্রশ্ন হলো, মশা নির্মূলে কি করছে দুই সিটি করপোরেশন? ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণে মশা নিধনের জন্য এক হাজারের ওপর মশক শ্রমিক কর্মরত আছেন। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫/৬ জন কর্মী আছে বলে পত্রিকায় জেনেছি। যাদের কাজ শুধু মশার ওষুধ ছিটানো। প্রতি বছর মশা নির্মূলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বছরে বরাদ্দ পায় দুই সিটি করপোরেশন। এত কিছুর পরও রাজধানীতে দিন দিন মশার প্রকোপ বেড়ছে কেন? এই বিপুল জনবল আর বিপুল পরিমাণ অর্থের সঠিক ব্যবহার হলেতো নগরীতে এভাবে মশা থাকার কথা না? সমস্যা আছে অনেক। জেনেছি, লোকবল আছে, ওষুধ আছে- তবে সে ওষুধ ঠিকঠাক মতো ছিটায় কিনা তার মনিটরিং নেই। এত লোক সারা বছর কাজ করলে, এত অর্থ ব্যয় করলে তো নগরীতে মশা জন্মানোর কথা না। মূল কথা হলো, যেখানে মশারা জন্ম নেয়, সেখানে ওষুধ পড়েই না। কর্মীরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে মশা তো বাড়বেই। পত্রিকায় মশা বাড়ার খবর ছাপা হলে কিছুটা দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়। এভাবে নগরীর মশানিধন হবে না। মশারা আয়েশেই হুল ফোঁটাবে সবার গায়ে। মশানিধনের জন্য অর্থ জনবলের পাশাপাশি মনিটরিং দরকার। মশানিধন করা না গেলে, এই মশার মাধ্যমে মারাত্মক রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। এডিস মশাসহ অন্যান্য মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা ভয়াবহ যন্ত্রণার কারণ হবে বৈকি! সুতরাং মশানিধনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ন্যূনতম গাফিলতি চলবে না। আমরা এও মনে করি, সিটি করপোরেশনদ্বয়ের পক্ষে এ কাজ করা খুব সহজসাধ্য হবে না যদি না নগরবাসীর কাছ থেকে যথাযথ সহায়তা আসে। নগরবাসীর উচিত, নগর বসবাস যোগ্য,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধই পারে এই নগরকে মশামুক্ত রাখতে। লক্ষ্য করা গেছে, সুনির্দিষ্ট কিছু অভিজাত এলাকা ছাড়া কোথাও ক্রাশ প্রাগ্রামের বাস্তবায়ন কম। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ প্রায় দেড় কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত মহানগরীতে নাগরিকদের সব সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্তি একই মানদন্ডে বিচার্য হলেও অন্তত সার্বিক বিচারে কিছুকিছু বিষয়ে সব নাগরিকের প্রাপ্তিতে সমতা থাকা উচিত। কারণ দিনভর পরিশ্রম করে একটি নির্বিঘœ ও সুখকর রাত সবাই প্রত্যাশা করে। আমাদের মনে রাখা উচিত, বিশাল বিশাল অট্টালিকার বাইরেও এ মহানগরীতে প্রায় চলিস্নশ লাখ লোক বস্তিতে বসবাস করে। সামর্থ্যহীন এ লোকগুলোর জীবন-জীবিকার দায়ভার বহন করাই যখন কষ্টসাধ্য, সে ক্ষেত্রে মশার উপদ্রব থেকে নিজেকে রক্ষার বিকল্প তাদের আর কী-ই বা থাকতে পারে। এ নগরীর রক্ষাকর্তারা কি তা কোনো দিন ভেবে দেখেছেন? ঢাকা সিটি করপোরেশন মশা নিধনের ব্যাপারে বড় বড় কথা বললেও বাস্তবে নগরবাসীকে মশা থেকে রক্ষার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। অভিজাতও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকা ছাড়া মশক নিধন কর্মীদের নগরীর অন্য কোথাও দায়িত্ব পালন করতে খুব একটা দেখা যায় না। যদিও ডিসিসি কর্তৃপক্ষ বলছেন, লিকুইড ইনসেক্টিসাইড নামক কীটনাশক দিয়ে নগরীতে উড়ন্ত মশা নিধনের বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। কিন্তু মানুষ এখনো তার বাস্তবায়ন পরখ করতে পারছে না। বরং দিন দিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আবদ্ধ ডোবানালা ওড্রেনগুলোয় মশার বিস্তার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ডিসিসিকে আরো জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, মশানিধনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনার অভাব যেমন রয়েছে- তেমনি রয়েছে জবাবদিহিতা ও মনিটরিংয়ের অভাবও। কোথাও কোথাও ওষুধ ছিটিয়ে কিংবা ফগার মেশিন চালিয়ে মশা দমন আদৌ সম্ভব নয়। মশা দমন ও নিধন করতে হলে মশার প্রজনন ক্ষেত্রের দিকে সর্বাগ্রে দৃষ্টি দিতে হবে। গোটা শহর কার্যত ময়লা-আবর্জনায় ভাগাড় হয়ে আছে। রয়েছে মাইলের পর মাইল খোলা নর্দমা। দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় তিন হাজার বিঘা ময়লা ফেলার জায়গা রয়েছে। এসব জায়গায় ফেলা ময়লা ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। ময়লা ফেলার স্থানগুলো মশা প্রজননের একেকটা 'উৎকৃষ্ট' ক্ষেত্র। খোলা নর্দমাগুলোও যথাসময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। মশার বংশ বিস্তারে নর্দমাগুলোর বড় রকমের ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় তিন হাজার বিঘা জলাশয় রয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি জলাশয়ই ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পূর্ণ। এগুলোও মশার উৎস হিসেবে কাজ করছে। মশার প্রজজন স্থলসমূহ অবারিত ও উন্মুক্ত রেখে মশা দমন ও নিধনে সফল হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না। প্রজনন ও উৎসস্থলেই মশার বংশ ধ্বংস করতে হবে। আবর্জনা দ্রম্নত অপসারণ করতে হবে। আবর্জনা ফেলার জায়গাগুলো সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে- যাতে ওই সব জায়গায় মশার জন্ম হতে না পারে। খোলা নর্দমাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে, ওষুধ দিতে হবে যাতে সেখানে মশা জন্মাতে না পারে। একইভাবে জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, নিয়মিত ওষুধ ছিটিয়ে মশার লাভা মুক্ত করতে হবে। উৎসে মশা দমন ও নিধন না করে উড়ন্ত মশা দমন ও নিধন কার্যক্রম চালিয়ে ঢাকাকে মশামুক্ত করা যাবে না। সিটি করপোরেশনদ্বয়কে এই সত্য উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ওয়ার্ড কমিশনারদের আরও দায়িত্বশীল ও সক্রিয় হতে হবে। এ বছর রাজধানীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় মশার উৎপাত বেশিই মনে হচ্ছে। এলাকার বাসিন্দারা এজন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) অবহেলাকে দায়ী করেন। তাদের মতে, বছরের নির্দিষ্ট সময় ডিসিসি মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলোতে ওষুধ ছিটানো হয়। এতে মশার বংশবৃদ্ধি কম হয়। কিন্তু এ বছর তা করা হয়নি। নাগরিকদের এ অভিযোগের সত্যতা মিলল নগর কর্তৃপক্ষের কথায়ও। তারা বলছে, ওষুধ সংকটের কারণে মশানিধনে নিয়মিত কর্মসূচি এবার চালাতে পারেনি তারা। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় মশার অত্যাচার। চায়ের দোকানে বসলেই মশা কামড়াতে শুরু করে। এলাকার নর্দমাগুলোতে আবর্জনা জমে থাকে। ডিসিসি আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার করে না। এলাকাবাসীও নিজের বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখে না। তাই, মশারা রাতেও কামড়ায়, দিনেও কামড়ায়। আগে দিনের বেলা এরা আন্ডারগ্রাউন্ডে অর্থাৎ ম্যানহোলে আত্মগোপন করে থাকত। রাতে বেরিয়ে আসত। এখন দিনরাত সবসময়ই এদের সমান আনাগোনা। রাতে বরং এদের আনাগোনা থেকে বাঁচার জন্য মশারির ভেতর আশ্রয় নেওয়া যায়; কিন্তু দিনের বেলায় মানুষের দিবানিদ্রার অরক্ষিত অবস্থার সুযোগ নিয়ে দিব্যি হুল ফুটিয়ে দেয় মশা। অবাধে চুষে নেয় তাজা রক্ত। এরা কানের কাছে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে মানুষের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেয়। মশা ক্ষুদ্র কীট। কিন্তু তার বিধ্বংসী ক্ষমতা ক্ষুদ্র নয়। বলা হয়, রাজা নমরুদকে জব্দ করতে আলস্নাহ পৃথিবীতে মশা পাঠিয়েছিলেন। মশার কামড়ে ধ্বংস হয়ে যায় নমরুদ বাহিনী। আত্মগর্বী রাজার জন্যও মৃত্যু ডেকে আনে এই ক্ষুদ্র কীট। বিপদ না চাইলে মেয়রসহ সিটি করপোরেশনের কর্তা ব্যক্তিদের কুম্ভকর্ণের ঘুম থেকে জাগতে হবে। নিজেদের সুনামের স্বার্থেই মশা নামের ভয়ংকর শত্রম্ন ঠেকাতে হবে। মশা মারা নিয়ে মশকরা অনেক হয়েছে। মানুষ এখন মশার কাছে জিম্মি। দোহাই মেয়র, আপনাদের মশা ঠেকান! এ মশা আপনাদের সুনামেই হুলফুটাবে।
মীর আবদুল আলীম : সাংবাদিক ও কলামিস্ট